ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে বহু গুরুত্বপূর্ণ শিব মন্দির। তীর্থক্ষেত্র এবং পারিবারিক ভ্রমণকেন্দ্র হিসেবে এই মন্দির গুলির গুরুত্ব অপরিসীম এবং পর্যটকদের অত্যন্ত প্রিয় গন্তব্যস্থল। আসুন দেখে নেওয়া যাক শিব ঠাকুরের দর্শন পেতে ভারতবর্ষের কোন কোন প্রান্ত হতে ঘুরে আসতে পারেন আপনিও।
কাশ্মীরের অমরনাথ মন্দির
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৮৮৮ মিটার উচ্চতায় কাশ্মীরের অতীবসুন্দর অমরনাথ গুহার মধ্যে এই মন্দির তথা শিবলিঙ্গের অবস্থান। তীর্থক্ষেত্র হিসেবে অন্যতম কঠিন, কিন্তু তীর্থযাত্রীদের কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যাত্রা হল অমরনাথ যাত্রা। অমরনাথ গুহার মধ্যে প্রতি বছর বরফ জমে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক শিবলিঙ্গ অন্যতম দর্শনীয় বিগ্রহ।
উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথ মন্দির
দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম হিসাবে কেদারনাথ শিবমন্দির অবস্থান করছে গারওয়াল হিমালয়ের ক্রোড়ে। উত্তরাখণ্ডের ছোটা চার ধাম যাত্রার একটি ধাম হিসেবেও এই মন্দিরটি অত্যন্ত বিখ্যাত। রাস্তাঘাট যথেষ্ট খারাপ হওয়ায় গৌরিকুণ্ড থেকে শেষ ২২ কিলোমিটার পথ পর্যটকদের ট্রেক করে উপরে উঠতে হয়, কিন্তু একবারে শীর্ষে দেখতে পাবেন হিমালয় পর্বতমালাকে পিছনে রেখে কেদারনাথ মন্দিরের অসাধারণ রূপ।
উত্তর প্রদেশের কাশী বিশ্বনাথ মন্দির
বারাণসী হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে পরিচিত অত্যন্ত পবিত্র একটি শহর হিসাবে, কথিত আছে কাশীতে মৃত্যুবরণ করার মানে জাগতিক জন্ম মৃত্যুর চক্রাকার সত্তা থেকে চিরতরে মুক্তি। সেই কথা মাথায় রেখে ভারতবর্ষের বহু দর্শনার্থী কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে এসে জীবন সার্থক করেন। অনতিদূরে অবস্থিত মণিকর্নিকা ঘাট শক্তিপীঠ হিসেবে বিখ্যাত।
পশ্চিমবঙ্গের তারকেশ্বর মন্দির
বাংলার নিজের তারকেশ্বরের বাবা তারকনাথ মন্দিরের কথা কে না জানে। সারাবছর ধরেই হুগলির এই মন্দিরে শরণার্থীদের ভিড় বজায় থাকে। অষ্টাদশ শতকে রাজা ব্রহ্মাল্যর পৃষ্ঠপোষকতায় এই মন্দিরের পথ চলা শুরু। মনে করা হয় কলকাতা অঞ্চলের সবথেকে পুরনো মন্দির হল এটি। ভক্তদের কাছে মন্দির দর্শনের পূর্বে সামনের দুধপুকুরে পুণ্যস্নান করার সুযোগও হয়ে ওঠে মহার্ঘ্য।
উড়িষ্যার লিঙ্গরাজ মন্দির
কলিঙ্গ স্থাপত্যশিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির। মন্দিরের মধ্যে শাস্ত্রীয় স্থাপত্যকলা মেনে রয়েছে বিমান অংশ, জগমোহন অংশ, নাটমন্দির অংশ এবং ভোগ-মণ্ডপ। এখানে মহাদেবের হরিহর অবতারের পূজা করা হয়। হিন্দু, বৈষ্ণব এবং শৈবধর্মের মিলনক্ষেত্র হিসাবে লিঙ্গরাজ মন্দিরের অবদান অনস্বীকার্য।
মহারাষ্ট্রের কৈলাসনাথ মন্দির
ফেলুদার কৈলাসে কেলেঙ্কারির গল্পের সেই কৈলাসনাথ মন্দির কিন্তু অবস্থিত মহারাষ্ট্রের ঔরাঙ্গাবাদের কাছে এলোরাতে। ভারতবর্ষের পবিত্রতম শিবমন্দিরগুলির মধ্যে এটি অন্যতম প্রাচীর, আনুমানিক ষষ্ঠ থেকে দশম খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রকূট রাজাদের শাসনকালে এই মন্দির স্থাপিত হয়। পাথর কেটে তৈরি করা এই মন্দিরের দৃষ্টি নান্দনিকতা অনস্বীকার্য।
গুজরাটের সোমনাথ মন্দির
ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রথম জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির হিসেবে স্থাপন করা হয়েছিল পবিত্র সোমনাথের শিবমন্দিরের। গুজরাটের পশ্চিম উপকূলের সৌরাষ্টের ভেরাভালে এই মন্দিরের অবস্থান। কপিলা, হিরণ এবং পৌরাণিক সরস্বতী নদীর ত্রিবেণী সঙ্গমে অবস্থিত সোমনাথ দর্শনার্থীদের পুণ্যসঞ্চয়ের পথে অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
তামিলনাড়ুর বৃহদেশ্বর মন্দির
দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় রাজাদের শাসনকালে তামিলনাড়ুর তাঞ্জর নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল স্থ্যাপত্যকলাবিদ্যার যুগান্তকারী নিশান হিসাবে। রাজা রাজা চোলার পৃষ্ঠপোষকতায় ১০০১ থেকে ১০১০ খ্রিস্টাব্দের মাঝে এই মন্দিরের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে এটি একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে খ্যাত এবং পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় তীর্থস্থল।
অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রী কালাহস্তী মন্দির
কালাহস্তীস্বর রূপে পূজিত শিব ঠাকুরের রূপ দেখতে হলে চলে আসতে হবে অন্ধ্রপ্রদেশের চিতটুর জেলায়। ভারতবর্ষের পঞ্চভূতস্থলের মধ্যে বিশেষ স্থান ধারণ করে এই মন্দিরটি। উত্তর ভারতের মতো এই মন্দিরটি অতটা জনপ্রিয় না হলেও, শাস্ত্রমতে এটি একটি অত্যন্ত পবিত্রস্থল। ভিড় এড়িয়ে মহাদেবের দর্শন করতে হলে এখানে আসতে পারেন।
কেরালার ভাড়াকুন্নাথন মন্দির
একই ভাবে আম বাঙালিদের কাছে আর একটি স্বল্প পরিচিত শিবমন্দির হল কেরালার ভাড়াকুন্নাথন মন্দির। কথিত আছে ঋষি পরশুরাম স্বয়ং কেরালার থ্রিসুরের কাছে মহাদেবকে ভাড়াকুন্নাথন হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। এপ্রিল মে মাসের থ্রিসুরের পুরাম উৎসবের সময়ে এই মন্দিরের জৌলুস হয়ে ওঠে দেখার মতো।
কর্ণাটকের মুরুদেশ্বরা মন্দির
আমরা দেখতে পাই দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মহাদেব বা শিব ঠাকুর পূজিত হয়েছেন বিশেষ বিশেষ রূপে। কর্ণাটকের মুরুদেশ্বরা মন্দির সেই মুকুটের আর একটি পালক মাত্র। এই মন্দিরের মহাদেবের মূর্তিটি বিশাল এবং প্রায় ২০ তলার কাছাকাছি উঁচু। দর্শনার্থীদের জন্যে রয়েছে লিফটে করে উপরে গিয়ে সামনাসামনি সেই মূর্তি দেখার সুযোগ।
মধ্যপ্রদেশের মহাকালেশ্বর মন্দির
মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীতে শিপ্রা নদীর তীরে অবস্থান করছে ভারতবর্ষের অন্যতম পবিত্র জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির এই মহাকালেশ্বর মন্দির। ১৮টি মহা শক্তিপীঠের মধ্যে এই মন্দির অগ্রগণ্য। মন্দিরের ভিতরে রয়েছে ওমকারেশ্বর মহাদেব এবং নাগচন্দ্রেশ্বরের বিগ্রহ। মহাকালেশ্বর মন্দিরটিকে ভারতবর্ষের অন্যতম জাগ্রত শিবমন্দর হিসাবে ভক্তরা মনে করেন।
এই মন্দিরগুলি ছাড়াও পুণ্যসন্ধানী পর্যটক ও তীর্থযাত্রীরা ঘুরে আসতে পারেন মহারাষ্ট্রের ত্রিম্বকেশ্বর মন্দির, ঝাড়খণ্ডের বৈদ্যনাথ মন্দির, কর্ণাটকের কোটিলিঙ্গেশ্বর মন্দির বা তামিলনাড়ুর চিদাম্বরম মন্দির থেকে।