ধান্যকুড়িয়া, কলকাতা থেকে মাত্র ৫২ কিলোমিটার দূরেই অবস্থিত এই স্থানটি। আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে বাংলা এবং কলোনিয়াল স্থাপত্যকলার সর্বশ্রেষ্ঠ কিছু নিদর্শন লুকিয়ে আছে এখানে। প্রাক স্বাধীনতাকালে বাংলার বহু জমিদার এবং বাবুদের গথিক শৈলীতে নির্মিত প্রাসাদপম নানা বাড়ির ঠিকানা এখনও কিন্তু এই ধান্যকুড়িয়া।
গ্রামবাংলার পথেঘাট দিয়ে যাওয়ার সময় কিন্তু আপনি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারবেন না যে এমন একটি গ্রাম চোখের সামনেই লুকিয়ে আছে, যেখানে পরে আছে একের পর এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্থাপত্যের বিস্ময়। টাকি থেকে কোনও এক উইকেন্ডে ফেরার সময়, আমার সঙ্গেও কিন্তু ঠিক তাই হয়েছিল। হঠাৎ করে এসে পড়েছিলাম ধান্যকুড়িয়ায় - আর জায়গাটা ঘুরে দেখতে শুরু করেছিলাম।
প্রথমেই পেলাম গায়েন জমিদারবংশের বাগানবাড়ি, গায়েন বাড়ির দেখা। তালা দেওয়া বাজখাঁই এক লোহার গেটের পিছনে গায়েন বাড়ি যেন ডিজনির সিনেমা থেকে তুলে আনা ব্রিটিশ ক্যাসল। ইংরেজ প্রাসাদগুলোর মতো এখানেও আছে বেশ কয়েকটি তুরেট। আর গেটের মাথায় ব্রিটিশ শৈলীর স্থাপত্য - সিংহের সঙ্গে যুদ্ধরত দুই ইউরোপীয়।
গায়েন বাড়ির চারিদিকে বর্তমানে গাছগাছালির বাড়বাড়ন্ত, দেখে মনে হতেই পারে যে আপনি ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের গ্রামের দিকেই চলে এসেছেন। তবে প্রবেশ কিন্তু অনুমতি সাপেক্ষ।
গায়েনদের এই বাগানবাড়ি থেকে একটু দূরেই কিন্তু গায়েনদের আসল রাজবাড়ির অবস্থান। গোলাপি রঙের এই বাড়ির সামনে বিশাল বড় মাঠ, দু'পাশে উঠে গেছে টাওয়ার। গায়েন বংশের বসতবাড়ি হিসেবে এই বাড়িটি কিন্তু বাঙালি এবং কলোনিয়াল স্থ্যাপত্যকলার মেলবন্ধনের আদর্শ নিদর্শন হয়ে উঠেছে। বাড়িটির প্রতি কোণায় অবস্থিত ডোম (Dome) গুলো একটি সাবেকি ঐতিহ্যের ছাপ বজায় রেখেছে। দু'তলা জমিদারবাড়ির আনাচে-কানাচে বিলাস বাহুল্যের ছাপ স্পষ্ট , আছে পুরনো আলোকস্তম্ভ, করিনথিয়ান শৈলীর থাম, ফোয়ারা এবং গাড়ি চালানোর জন্য নির্দিষ্ট একটি বিশাল ড্রাইভওয়ে।
![Photo of Dhanyakuria, West Bengal, India by Aninda De](https://static2.tripoto.com/media/filter/nl/img/2033349/TripDocument/1613535476_1594583263_img_20190803_111411.jpg.webp)
প্যালেসের বাইরের দিকে আছে বেশ কয়েকটি টাওয়ারের মতো গঠন, আর রয়েছে বাড়ির দেব-দেবী বিগ্রহের পূজার জন্যে মন্দির। বসতবাড়ি হওয়ার কারণে মূল বাড়ির ভিতরে ঢোকার অনুমতি পাওয়া যায় না। তবে বহু বাংলা সিরিয়াল বা সিনেমার শুটিং এই চার দেওয়ালের মধ্যে হয় মাঝে মধ্যেই।
![Photo of কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার অদূরেই অবস্থিত স্থাপত্যকলার অনন্যসুন্দর নিদর্শন - ধান্যকুড়িয়া by Aninda De](https://static2.tripoto.com/media/filter/nl/img/2033349/TripDocument/1613535539_1612460131_1612460127941.jpg.webp)
![Photo of কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার অদূরেই অবস্থিত স্থাপত্যকলার অনন্যসুন্দর নিদর্শন - ধান্যকুড়িয়া by Aninda De](https://static2.tripoto.com/media/filter/nl/img/2033349/TripDocument/1613535612_1612460072_1612460066872.jpg.webp)
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য - সাদা রঙের সাউ ম্যানসন। বাড়ি জুড়ে রয়েছে বিলিতি কায়দায় তৈরি গম্বুজাকৃতি জানলা, যার আর্কের উপর করা হয়েছে স্টাককো স্টাইলে ডেকোরেশন। চারধারে করিনথিয়ান থাম দিয়ে সাজানো মাঝের বড় উঠোনটি দেখার মতো। পুরনো বাংলার আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারগুলোর মতো সাউ ম্যানসনেও আছে থাম দিয়ে ঘেরা ঠাকুরদালান এবং নাটমন্দির। এতদিন পরেও এই অংশ দুটি কিন্তু বেশ ভালভাবেই আছে। স্থানীয়রা জানালেন যে প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময় এখানে পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং সাউ বংশের প্রাচীন এবং নবীন প্রজন্ম এই সময়ে এক ছাদের তলায় সকলে জড়ো হন।
![Photo of কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার অদূরেই অবস্থিত স্থাপত্যকলার অনন্যসুন্দর নিদর্শন - ধান্যকুড়িয়া by Aninda De](https://static2.tripoto.com/media/filter/nl/img/2033349/TripDocument/1613535660_1612438901_1612438867539.jpg.webp)
এরপরে হেঁটে এগিয়ে গেলাম বল্লভ ম্যানসন বা বল্লভ বাটির উদ্দেশ্যে। সবুজে সাদায় রঙ করা এই বাড়িটি এখনও যত্ন সহকারে সংরক্ষিত। বল্লভ বাটির প্রাক্তন প্রজন্মরা জুটের ব্যবসায়ে প্রচুর লাভবান হয়েছিলেন। বাড়ির ছাদের প্রতি কোণে একটি করে ইউরোপীয় স্ট্যাচু দেখা যায়। ঢোকার ঠিক মুখে, উপরদিকে আছে মাথায় মুকুট পরা সম্ভবত কোনও ইউরোপীয় রাজার মূর্তি, তার দুপাশে দুজন এশীয় ব্যক্তি। সম্ভবত ব্রিটিশ রাজের প্রতি বাংলার জমিদারদের আনুগত্য দেখানোর জন্যেই এই মূর্তির উপস্থাপনা। এই সমস্ত মুর্তিগুলোর জন্যে বাড়িটিকে পুতুলবাড়িও বলা হয়ে থাকে।
![Photo of কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার অদূরেই অবস্থিত স্থাপত্যকলার অনন্যসুন্দর নিদর্শন - ধান্যকুড়িয়া by Aninda De](https://static2.tripoto.com/media/filter/nl/img/2033349/TripDocument/1613535718_1594562371_img_20190803_120920.jpg.webp)
বল্লভ বাটির এক তলায় সারি দিয়ে বেশ কিছু ভগ্নপ্রায় ঘর আছে পরপর, যা মূল বাড়িটির সঙ্গে একেবারেই বেমানান। হয়তো আগে ঘরগুলো চাকরদের থাকার জন্যে ব্যবহার করা হতো। জমিটির বাঁ দিকের অংশটি তুলনামূলক ভাবে আরেকটু অনাদরে পরে রয়েছে। সরু, নিচু সিলিং-ওয়ালা একটি সাইডের প্রবেশপথ দিয়ে ভিতরে ঢোকা যায় - এর বাইরের দিকে রয়েছে একটি তিনতলা টাওয়ার।
ইতিহাস, স্থাপত্য বা গ্রাম বাংলার রূপ স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছে থাকলে যে কোনও দিন ঘুরে আসতে পারেন ধান্যকুড়িয়া থেকে। বাংলার বণিকদের জৌলুস, জাঁকজমক আমরা কোনওদিন সামনাসামনি দেখতে পাইনি। আজ তাদের সম্পত্তি হয় ভুলণ্ঠিত হয়ে মাটিতে মিশে গেছে, না হয় আমাদের ক্যামেরার গ্যালারিতেই আটকে পড়ছে, স্মৃতির পর্দায় বিরাজ করার জন্যে।
![Photo of কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার অদূরেই অবস্থিত স্থাপত্যকলার অনন্যসুন্দর নিদর্শন - ধান্যকুড়িয়া by Aninda De](https://static2.tripoto.com/media/filter/nl/img/2033349/TripDocument/1613535776_1594562611_img_20190803_121405.jpg.webp)
ধান্যকুড়িয়া কীভাবে পৌঁছবেন
কলকাতা থেকে ধান্যকুড়িয়া মাত্র দু-ঘণ্টার দুরত্বে এবং গাড়ি করে সহজেই সেখানে যাওয়া যায়। ইচ্ছে করলে ট্রেনেও যেতে পারেন - বসিরহাট লোকাল চেপে ধান্যকুড়িয়া পৌঁছাতে দুই ঘণ্টার একটু বেশি সময় লাগে।