২০২০ সালের ভয়াবহ করোনা মহামারীর কারণে, দীর্ঘ ১০ মাস ঘরবন্দি থাকার পরে বিশ্বের প্রত্যেকটা মানুষের মতো আমারও মুক্তির স্বাদের সুপ্ত ইচ্ছাটা মনের ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিল | আর মনের মধ্যে ফিকে হয়ে যাওয়া ভ্রমণের স্মৃতিগুলোকে আবার নতুন করে জাগিয়ে তোলার জন্য বাঙ্গালির নস্টালজিক' দী-পু-দা' র মধ্যে 'দা' কেই বেছে নিলাম | হ্যাঁ, এক্কেবারে ঠিক ধরেছেন নিউ নর্মাল জীবনের প্রথম ভ্রমণ স্থান হিসেবে দার্জিলিংকেই বেছে নিলাম |
কাজের ফাঁকে যাওয়া আসা নিয়ে মাত্র তিনদিনের জন্যই দার্জিলিং ভ্রমণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল | পর্যটকের তেমন ভিড় না থাকায় ট্রেনের টিকিট থেকে হোটেল বুকিং সমস্তটাই খুব সহজেই পাওয়া গেল| সপ্তাহান্তে শীতের রাতের শিয়ালদহ স্টেশন থেকে করোনা ভয়কে সঙ্গে নিয়েই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে উঠে পড়লাম দার্জিলিং মেল-এ |
প্রথম দিন:
ভোরের নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন এর মিষ্টি অভ্যর্থনাকে সঙ্গে নিয়ে, একটা গাড়ি ভাড়া করে রওনা হলাম দার্জিলিং-এর উদ্দেশ্যে | মনের মধ্যে এই শৈল শহর এবং লকডাউন পর্ববর্তী সময়ের ভ্রমণ সম্পর্কে নানা কৌতূহল নিয়ে সমতল, পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে, মেঘ ও রোদের খেলা দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম আপামর বাঙ্গালির স্বপ্নের শৈল শহর দার্জিলিং-এ |
হোটেলে চেক- ইন করার আগে হোটেল কর্মীবৃন্দ আমাদের সমস্ত ব্যাগ এবং জুতো স্যানিটাইজ করলেন | প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, দার্জিলিং-এর কোনও হোটেলেই বিনা মাস্ক প্রবেশের অনুমতি নেই; স্যানিটাইজার দ্বারা পরিশুদ্ধির পরেই হোটেলে প্রবেশের অনুমতি মেলে এবং হোটেলে চেক-ইন এর সমস্ত রকম পদ্ধতি এখানে আপনাদের ডিজিটাল পদ্ধতিতে করতে হয় | হোটেলের রুম থেকে টাওয়াল সমস্ত কিছুই জীবাণু মুক্ত | দুপুরের লাঞ্চ সেরে পৌঁছে গেলাম দার্জিলিং ম্যালে | অন্য সময় যেমন ম্যাল জনসমুদ্রের ভিড়ে হারিয়ে যায়, লকডাউন পরবর্তী সময়ে কিছুটা নিজস্ব ছন্দের ম্যালকে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন | পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় নেই, আর সকলেই করোনা প্রকোপ থেকে বাঁচতে মুখ ঢেকেছেন মাক্সের ভিতরে | শীতের বিকেলের মিঠে রোদ গায়ে মেখে ছোট্ট একটা ট্রেক করে পৌঁছে গেলাম মহাকাল মন্দিরে| মহাদেবকে দর্শন করে হাতে গরম লেবু চা নিয়ে হিমালয়ের সঙ্গে খোশ মেজাজে হালকা বার্তালাপ করতে করতে শুভরাত্রি অভিবাদন নিয়ে ফিরে গেলাম হোটেলে | রাত্রে দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত মোমো খেয়ে ভ্রমণের প্রথমদিনটি সম্পন্ন করলাম |
দ্বিতীয় দিন:
পরদিন অন্ধকার থাকতে থাকতে বেড়িয়ে পড়লাম টাইগার হিলের উদ্দেশ্যে | ভোরের মৃদু মধুর হাওয়ার সঙ্গে অগণিত দর্শকের মতো আমিও অপেক্ষামান থাকলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে সুন্দর একটা সকালকে প্রত্যক্ষ করার জন্যে | ঠিক সকাল ৬টা নাগাদ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সোনালি আভায় মাখা কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পেলাম | সূর্যের প্রথম কিরণে কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোমোহিনী রূপকে চিরদিনের জন্য স্মৃতির পাতায় বন্ধক রেখে ফিরে গেলাম হোটেলে |
হোটেল ফিরে ফ্রেশ হয়ে প্রাতঃ রাশ সেরে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম দার্জিলিং-এর অন্যান্য দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করতে| প্রথমেই দার্জিলিং-এর প্রসিদ্ধ মনেস্ট্রিগুলো দর্শন করে নিলাম | পার্বত্য অঞ্চলের সকালের স্নিগ্ধতা এবং মনেস্ট্রির পবিত্রতা এই দুইয়ের কম্বিনেশনে অভিজ্ঞতাটা বেশ মনোরম লাগছিল | তবে দার্জিলিং-এ বেশিরভাগ মনেস্ট্রি দর্শণার্থীদের জন্য করোনার কারণে বন্ধ ছিল | আর যে মনেস্ট্রিগুলো খোলা ছিল সেখানে করোনা আবহে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম যেমন মাস্ক পড়া, স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া ইত্যাদি বিধি অবলম্বন করার পরই প্রবেশের অনুমতি মেলে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, করোনার জন্য এখন রোপে-ওয়ে বন্ধ আছে। এর পর বাতাসিয়া লুপ, রক গার্ডেন, দার্জিলিং এর প্রসিদ্ধ হিমালয়ান চিড়িয়াখানা, তেনজিং রক, এবং দার্জিলিং এর চা বাগান ইত্যাদি ঘুরে লাঞ্চ করে ফিরে এলাম হোটেলে | বিকেলে স্থানীয় বাজার থেকে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কিছু কেনাকাটি করে হোটেলে ফিরে গেলাম| এবার এই স্বপ্ন শহর থেকে বিদায় নেয়ার পালা |
তৃতীয় দিন:
হোটেলে প্রাতঃ রাশ সেরে চেক আউট করে বেড়িয়ে পড়লাম | হোটেলে কর্মীবৃন্দের আতিথেয়তা ও বাঙ্গালির স্বপ্নের দার্জিলিং ভ্রমণ শেষ করে ফেরার পথের দিশা হিসেবে বেছে নিলাম ভায়া মিরিক শহরের রাস্তা টিকে | দার্জিলিং থেকে জলপাইগুড়ি ভায়া মিরিক হয়ে যেতে সময় লাগে প্রায় ৫ ঘণ্টা | তবে এই পথে আপনার সঙ্গী হতে চলেছে ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম, চা বাগান, মেঘ রোদ্দুরের খেলা, ঘন সবুজের জঙ্গল, আর অবশ্যই পাহাড় | ঘণ্টা দুয়েক রাস্তা অতিক্রম করে আপনি পৌঁছে যাবেন সীমানা অর্থাৎ ভারত ও নেপাল সীমান্তে | আপনি জাস্ট কল্পনা করুন, যে রাস্তা ধরে আপনি এগিয়ে চলেছেন তার বাঁ দিকে ভারত আর ডান দিকে নেপাল| এই ধরণের রোমহর্ষক যাত্রা প্রত্যক্ষ করতে করতে পৌঁছে গেলাম মিরিকে| এখানে একটি চা বাগান ও মিরিকের বিখ্যাত লেক দেখে ঘণ্টা দুয়েক দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম নিউ জলপাইগুড়িতে |
আর এখানেই আমাদের যাত্রার শেষ |
সব শেষে এই টুকু বলতে পারি, করোনা আবহের পর দার্জিলিং শহর যেমন ছিল ঠিক তেমনই আছে | বড়দিনের দিন থেকে দার্জিলিং-এর টয় ট্রেনে চেপে জয় রাইডেরও সূচনা হয়েছে | সমস্ত রকম নিয়মাবলী মাথায় রেখে কয়েকদিনের জন্য নির্দ্বিধায় এখানে ছুটি কাটিয়ে আসতে পারেন | এই শৈল শহরটি এখনও নতুন রঙে নতুন রূপে সৌন্দর্যের পাখা মেলে সুসজ্জিত আছে আপনার আশায় |
এই নিউ নর্মালে দার্জিলিং-এ যেতে হলে মনে রাখা প্রয়োজন
• মাস্ক ও স্যানিটাইজার সব সময় সঙ্গে রাখবেন এবং বারবার হাত স্যানিটাইজ করতে ভুলবেন না।
• আপনার ভারতীয় আইডি কার্ডটিও সঙ্গে থাকা অবশ্য জরুরি।
• যতটা পারবেন ডিজিটাল লেনদেন-এর চেষ্টা করবেন। এতে অন্যের সঙ্গে সংস্পর্শ অনেকটা এড়ানো যাবে।
• ট্রেনে আপনাকে কিন্তু কোনও বেড-রোল দেওয়া হবে না। সুতরাং নিজের বেডশিট নিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।
• কিছু মনাস্ট্রি এবং রোপেওয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে।
• এই সময় করোনার আবহে পর্যটকের আনাগোনা অনেকটাই কম। সুতরাং আপনি চাইলে একটু দরাদরি করে সস্তার মধ্যে ভাল হোটেল অনায়াসে পেয়ে যাবেন।