১৭৮৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ঐতিহাসিক অঞ্চল হিসেবে নদিয়া জেলার আত্মপ্রকাশ হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী নামক একজন জনৈক ব্যক্তির মতানুসারে, ভাগীরথীর তীরে চরভূমিতে একজন তান্ত্রিক ন'টি প্রদীপ জ্বালিয়ে তন্ত্র সাধনা করতেন। দূর থেকে এই জায়গাটিকে দেখে লোকে ন'দিয়ার চর বলতেন, সেই থেকেই লোকমুখে প্রচলিত হয় এই 'নদিয়া' নামটি।
নদিয়া জেলায় অবস্থিত প্রসিদ্ধ কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র
নবদ্বীপ:
নদিয়া জেলায় অবস্থিত সুপ্রাচীন শহর। ১০৬৩ খ্রিস্টাব্দে এই শহর প্রতিষ্ঠিত। বৈষ্ণব ধর্মের পীঠস্থান হিসাবে নবদ্বীপ পরিচিত।১১৫৯ সাল থেকে ১২০৬ সাল পর্যন্ত বাংলায় সেন রাজাদের আমলে রাজধানী ছিল নবদ্বীপ। ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের দোলপূর্ণিমার দিন নবদ্বীপের শ্রী চৈতন্য দেবের আবির্ভাব ঘটে। এটি শ্রীচৈতন্যদেবের দ্বিতীয় পত্নী বিষ্ণুপ্রিয়ারও জন্মস্থান। পুরসভার তথ্য অনুযায়ী ১৮৬টির বেশি মন্দির নবদ্বীপে অবস্থিত।
গন্তব্য স্থানে পৌঁছানোর পথনির্দেশিকা:
হাওড়া ও শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে নবদ্বীপ যাওয়া যায়। শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে প্রথমে কৃষ্ণনগরে পৌঁছতে হবে,তারপর ন্যারোগেজ লাইনে ট্রেন ধরে নবদ্বীপ ধামে পৌঁছে ফেরি পেরিয়ে নবদ্বীপে যাওয়া যায়। অথবা বাসে করে সরাসরি নবদ্বীপে পৌঁছনো যায়। এছাড়া কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে অটো করে স্বরূপগঞ্জ ঘাটে পৌঁছে ফেরিঘাট পেরিয়ে নবদ্বীপ যাওয়া যায়।
থাকবার জায়গা:
নবদ্বীপধাম স্টেশনের কাছে মিউনিসিপ্যালিটির ট্যুরিস্ট লজ, এছাড়াও বেসরকারি লজ,ধর্মশালা ও অথিতিশালায় পর্যটকদের থাকার সুবন্দোবস্ত আছে।
স্থানীয় অনুষ্ঠান:
নবদ্বীপের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্যতম হল রাস-উৎসব। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে খুব ধুমধাম করে রাস উৎসব পালন করা হয়। এছাড়াও দোল পূর্ণিমা, চন্দন যাত্রা, ধুলোট মেলা, গঙ্গা পূজা,ঝুলন যাত্রা প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলো খুব বড় করে এখানে পালিত হয়।
নবদ্বীপের বিখ্যাত ১০টি দর্শনীয় স্থান:
১. শ্রী শ্রী কেশবজি মঠ: নবদ্বীপের এটি সবথেকে প্রসিদ্ধ এবং সুবিশাল মঠ। এখানে একটি মিউজিয়াম আছে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণের লীলাখেলার বিভিন্ন আঙ্গিকে। মূর্তি দেখা যায়।
২. জল মন্দির: এই মন্দিরটি জলাশয় এর মাঝখানে অবস্থিত এবং এখানে প্রচুর হরিণ দেখতে পাওয়া যায়।
৩. নরহরি শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য সেবা মিশন: এখানে বিশ্বের সবথেকে বড় ৬০ ফুট উচ্চতার নিমাই-এর মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়।
৪. পোড়ামা তলা মন্দির: এইখানে মা কালীর মূর্তি পূজিত হতে দেখা যায়।নামকরণের ইতিহাসের পিছনে জানা যায় কোনও এক সময় এই মায়ের মূর্তি বজ্রপাতের ফলে পুড়ে গিয়েছিল, তারপর থেকে এখানকার নাম এইরূপ হয়।
৫. বুড়ো শিব মন্দির: এটি নবদ্বীপের সবচেয়ে প্রাচীনতম শিব মন্দির।
৬. মনিপুর রাজবাড়ি: এই রাজবাড়িতে এখনও মনিপুর বংশধরেরা আসেন এবং গৌরাঙ্গের বিগ্রহ দেখতে পাওয়া যায়।
৭. পাখিরালয়(পূর্বস্থলী): নবদ্বীপ থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই পাখিরালয় বিভিন্ন পরিযায়ী পাখিসহ এবং প্রায় ১০০ রকমের পাখি দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে শীতের সময় এই স্থানটি খুব আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
৮. শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য সেবা মিশন ও গুপ্ত বৃন্দাবন: এটি আরেকটি প্রাচীন মন্দির,যেখানে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য বিগ্রহ বর্তমান। মন্দিরে রয়েছে গুপ্ত বৃন্দাবন যেখানে মূর্তি আর বিভিন্ন রকমের আলোর মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণর লীলা প্রদর্শিত হয়।
৯. নদিয়া ঘাট: শোনা যায় মহাপ্রভু এই ঘাট পেরিয়ে কাটোয়া গিয়ে সন্ন্যাসী হন।
১০. জগন্নাথ মিশ্রের বাড়ি: এটি শ্রী গৌরাঙ্গের জন্মস্থান। এছাড়াও এখানে মনস্কামনা পূরণের জন্য একটি কাছে সুতো বাঁধা হয়।
নবদ্বীপের ছোট-বড় মিলিয়ে এত অসংখ্য মঠ আছে, যা পরিদর্শন করতে আপনার মোটামুটি ২ থেকে ৩ দিন অনায়াসে কেটে যাবে। এখানে প্রতিটি মঠ দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত বন্ধ থাকে। প্রায় সকল মঠেই প্রবেশ মূল্য নেওয়া হয় এবং এখানে প্রতিটি মঠে রসকলি করা হয়।।
মায়াপুর:
নদিয়া জেলার একটি বিশেষ গ্রাম এবং পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র। ভাগীরথী নদীর পূর্বপাশে এই মায়াপুর অবস্থিত। মায়াপুরের খুব কাছে জলঙ্গি নদী ভাগীরথী নদীতে মিশেছে।
গন্তব্য স্থানে পৌঁছনোর পথ নির্দেশ:
সড়কপথে কলকাতা থেকে মায়াপুর যাওয়া যায়। শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে কৃষ্ণনগর এসে তারপর কৃষ্ণনগর থেকে বাসে মায়াপুর যাওয়া যায়।
থাকবার জায়গা:
বাস থেকে নেমেই মায়াপুর প্রবেশ করতে বিভিন্ন হোটেল বা লজে থাকার সুব্যবস্থা আছে।
স্থানীয় অনুষ্ঠান:
জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, স্নানযাত্রা, শ্রীল প্রভুপাদ-এর ব্যাস পূজা, দোলযাত্রা প্রভৃতি।
মায়াপুরের বিখ্যাত পাঁচটি দর্শনীয় স্থান:
১. ইসকন মন্দির: এটি সবথেকে বড় বৈদিক মন্দির। মন্দিরের চূড়ায় সোনার পাতে মোড়া এবং স্টেনলেস স্টিলে তৈরি করা একটি সুদর্শন চক্র অবস্থিত। যার উচ্চতা ২৩ ফুট এবং ওজন প্রায় দেড় টন। এই চক্রটি তৈরি হয়েছে রাশিয়াতে। খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এছাড়াও ইসকন মন্দিরে রয়েছে প্রভুপাদ-এর সমাধি। শ্রী চৈতন্যদেবের জন্মস্থান হিসেবে মায়াপুর 'চন্দ্রোদয় মন্দির' নির্মাণ করেন সন্ত বিনোদ ঠাকুর। চন্দ্রোদয় মন্দিরে গোপিনী পরিবেষ্টিত শ্যাম-রাইয়ের মূর্তি রয়েছে। জলঙ্গীর গঙ্গা সঙ্গমস্থলে মন্দির নির্মিত হয়েছে। এছাড়াও এখানে ছেলেদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য রয়েছে বৈদিক একাডেমি। পর্যটকদের জন্য এখানে ভোগ প্রসাদের ব্যবস্থা রয়েছে এবং কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানে এখানে বিভিন্ন ভবনের দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় পর্যটকদের থাকার জন্য।
২. বল্লাল সেনের ঢিপি: এখানে লক্ষণ বল্লাল সেনের আমলে প্রাসাদ ছিল বলে জানা গিয়েছে।বর্তমানে পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনের দ্বারা স্থানকে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটি উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট এবং প্রশস্থ প্রায় ৪০০ ফুট। ইতিহাসবিদদের মতে, এটি বিজয়নগরের ধ্বংসাবশেষ।
৩. চাঁদকাজির সমাধিস্থল: ভক্ত চাঁদকাজিকে মহাপ্রভুর নিজের হাতে এখানে সমাধি দেন এবং সেই সমাধি স্থানে তিনি একটি চাঁপা ফুল গাছ রোপণ করেছিলেন। যেই গাছটির বয়স প্রায় ৫০০ থেকে ৫৩০ বছর। সেই গাছ থেকে আজও মহাপ্রভুর জন্মস্থান পূজার ফুল পাঠানো হয়।
৪. মায়াপুর শ্রী চৈতন্য মঠ: সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত এই মঠটি ইসকন মন্দির তৈরির আগে প্রধান প্রাচীন মঠ। এখানে চৈতন্যদেবের মাসি মেসোর বাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। আর আছে রাধাকুণ্ড যেখানে পুকুরে রয়েছে বড় বড় মাছ।
৫. শ্রীবাস অঙ্গন: এখানে জগাই-মাধাই শ্রীচৈতন্যদেবের খোল ভেঙে দিয়েছিলেন। এখানে এখনো সেই খোলটি সংরক্ষণ করে রাখা আছে।
এছাড়াও মায়াপুরের রয়েছে আরও অসংখ্য মন্দির। তবে বেশিরভাগ মন্দিরগুলো দুপুর ১টা থেকে ৩টে অবধি বন্ধ থাকে এবং এই সমস্ত মঠের নিয়ম অনুযায়ী মন্দির প্রাঙ্গণে মোবাইল ফোন আর ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলা বা প্রবেশ করা নিষিদ্ধ। এছাড়া একসঙ্গে আপনারা শান্তিপুরের ভ্রমণ করতে পারেন,শান্তিপুরে ও বেশকিছু মন্দির এবং তীর্থস্থান আছে।