তাঁত শিল্পের ইতিহাস
সূচনাপর্বে জানা যায় আদি বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরা ছিলেন আদি তাঁতি সম্প্রদায়। একটা সময়ে তাঁরা 'তন্তুবায়' নামে বিশেষ পরিচিত ছিল। এরা প্রধানত যাযাবর শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সিন্ধু উপত্যকার অববাহিকায় বসবাস করার পর, সেই স্থান ছেড়ে এঁরা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় এসে তাঁতের কাজ শুরু করেন এবং ঠিক তারপর থেকেই বাংলায় এই তাঁতশিল্প বিস্তৃতি লাভ করে। এছাড়াও বলা হয়,মণিপুরিরা নিজেদের পোশাকের প্রয়োজনে তাঁতের কাপড় তৈরি করত। পরবর্তীতে তাঁদের তৈরি তাঁতের এই পোশাক বাঙালি সমাজে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
নদিয়া জেলায় তাঁত শিল্পের সম্ভার
নদিয়া জেলায় তাঁত শিল্পের কথা বললেই প্রথমেই যে দুটি জায়গার নাম উঠে আসে, সেটি হল শান্তিপুর এবং ফুলিয়ার তাঁত। ফুলিয়া তাঁত শিল্পের ইতিহাস সম্বন্ধে তেমন কিছু বিবরণ না পাওয়া গেলেও শান্তিপুরের তাঁত শিল্প সম্বন্ধে কিন্তু বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। ১৪০৯ সালের গৌড়ের রাজা গণেশ দানু সাধনদেবের সময়ে শান্তিপুরে প্রথম শাড়ি বোনার সূচনা হয়। কিন্তু সেই শাড়ির বাণিজ্যিকভাবে কদর বাড়ে রাজা রুদ্রদেবের (১৬৮৩-১৬৯৪ সাল) সময় থেকে এবং এই শিল্পের আসল রূপ ধরা পড়ে স্বাধীনতার পরে থেকে আর এই ভাবেই বাংলার ঘরে ঘরে তাঁত শিল্পের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ ঘটতে শুরু করে।
বাংলার শান্তিপুর এবং ফুলিয়ার তাঁতের শাড়ি সুপ্রসিদ্ধ হলেও দুটি শাড়ির মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য দেখা যায়।
এই স্থানের তাঁতের শাড়িগুলো প্রথম থেকে পরম্পরা নির্ভর ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ। এইখানকার তাঁতের শাড়ির বিশেষ আকর্ষণ হল পাড়ের নকশা এবং কারুকার্য। যেই নকশাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই হল ফুল, জ্যামিতিক আকার, পৌরাণিক ঘটনাবলীর, মন্দির ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায় এবং এই প্রত্যেকটি নকশার আলাদা আলাদা নাম আছে যেমন-নীলাম্বরী, গঙ্গা-যমুনা, ভোমরা, বেংকিপা, রাজমহল, চান্দমালা, আঁশ পাড়, বৃন্দাবনী ময়ূর পাড় ইত্যাদি। শান্তিপুর শাড়ির ভাঁজকে বলা হয় 'গুটিভাঁজ'।
সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল শান্তিপুর একমাত্র জায়গা যেখানে এখনও হ্যান্ডলুম-এ তৈরি শাড়ির উপর বেশি নজর দেওয়া হয়। সেই জন্যই শান্তিপুরের তাঁতের শাড়ির মান প্রথম থেকে আজ অবধি গুণগত দিক বিচারে একই রকম রয়েছে। তাই এই শাড়ি ক্রয় করতে শান্তিপুরে প্রতি বৃহস্পতিবার এবং রবিবার সকালে "বঙ্গের হাট"-এ বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের ঢল নামে।
ফুলিয়া তাঁত
এই স্থানের শাড়িগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সৃজনশীলতা। অর্থাৎ শাড়ির গুণগতমান বজায় রেখে প্রতিটি শাড়ির উপরে অভিনবত্ব ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টায় ফুলিয়ার তাঁতে লক্ষণীয়।
বিখ্যাত কিছু তাঁত শিল্পীবৃন্দ
সরস্বতী সরকার (রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত) সমর শীল, অচিন্ত্য মোদক,সুজিত পাল প্রমুখ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসার উত্থান-পতন:
আভিজাত্যময় ব্যবসার মধ্যে অন্যতম একটি হল তাঁত শিল্প। যার কাঁচামাল যোগান থেকে শুরু করে শাড়ি প্রেমীদের হাতে পৌঁছনো পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপে শৈল্পিক সত্ত্বা লুকিয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে এই পরিস্থিতিতে অন্য সবকিছুর মতোই প্রভাব পড়েছে এই তাঁত শিল্পের উপর। শান্তিপুর ফুলিয়ার বেশিরভাগ ঘরে ঘরে এখনও পর্যন্ত প্রধান জীবিকা রূপে এই তাঁত শিল্পকেই সবাই গ্রহণ করেছে। তাই মন্দার বাজারে যে শুধুমাত্র মহাজনদের কাছ থেকে কেনা কাঁচামালের দাম বেড়েছে তা নয়,প্রবল সংকটের মুখে পড়েছে এই তাঁত শিল্প।
ফুলিয়ার দুজন তাঁত শিল্পের ব্যবসায়ী বিনয় বসাকের এবং অয়ন ধানী-র কথায় সেটি বেশ ভালভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন যে, "কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়াতে কিছুটা হলেও শাড়ি তৈরির শিল্পে টান ধরেছে এবং এর ফলে শাড়ির দাম যেমন বেড়েছে সেই তুলনায় বিক্রি অনেকটাই কমে গিয়েছে।" কিন্তু এরপরেও নিজেদের রোজগারের তাগিদে এঁনারা আজ সোস্যাল মিডিয়া নির্ভর বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেছেন।
আগের মতো প্রচার এবং প্রসার না থাকলেও অনলাইনে কিছুটা আলোর দিশা দেখতে পেয়েছেন এই সমস্ত ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এরপরেও দ্রব্যাদির চাদিহা কমায় সংকটময় পরিস্থিতির আপদকালীন ব্যবস্থার স্বরূপ অনেক তাঁতি তাদের এই নিজস্ব রোজগারের পথ ছেড়ে যোগদান করেছে বিভিন্ন পেশায়।
আধুনিকতার মেলবন্ধনে এই শিল্পের উন্নতিতে হারিয়ে যাচ্ছে পরম্পরা। 'হ্যান্ডলুম'-এ তৈরী হওয়া তাঁতের শাড়ি এখন পরিবর্তিত হয়ে স্থান পেয়েছে 'পাওয়ার লুম' মেশিনে। যেখানে খুব স্বল্প ব্যয়ে,অল্প সময়ে,প্রবল পরিমাণ শাড়ি উৎপন্ন করতে সম্ভব হলেও, কমেছে শাড়ির গুণগত মান।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পুরস্কারপ্রাপ্ত তাঁত শিল্প ব্যবসায়ী বীরেন কুমার বসাক কিন্তু তাঁর ব্যবসায় আজও ঐতিহ্য, পরম্পরা এবং আভিজাত্য বজায় রেখে হ্যান্ডলুম-এ প্রতিনিয়ত তাঁতের কাপড় বুনে চলেছেন। যা শুধু দেশে নয় বিদেশের মাটিতেও সমানভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।