স্নানযাত্রার ঠিক ১৫ দিন পর অর্থাৎ ১৬ দিনে আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে বিষ্ণুর অবতার রূপে জগন্নাথ দেবের পুজো হয়ে থাকে, যেটি আপামর হিন্দু বাঙালির কাছে রথযাত্রা নামে পরিচিত। এই দিন শুধু উড়িষ্যা নয়; পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ধুমধাম করে রথযাত্রা পালন করা হয়। কথিত আছে, রথযাত্রার দিন জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা গুন্ডিচা মন্দির থেকে মাসীর বাড়ির দিকে গমন করেন। আর উল্টো রথের দিন পুনঃরায় তাঁরা নিজের ফিরে আসেন। মাসীর বাড়ি যাওয়ার আনন্দে বিভিন্ন জায়গায় রথযাত্রা সঙ্গে মেলাও দেখতে পাওয়া যায়।
পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দির ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রা, গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র মঠের রথ, পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, এবং সর্বোপরি ইসকনের রথ বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ।
১৩৯৬ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুর শহরে এই রথযাত্রা উৎসব পালন হয়ে আসছে; যা বর্তমানে ভারতের দ্বিতীয় এবং বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রা উৎসব। মাহেশের রথ যাত্রার ইতিহাস কিন্তু বেশ প্রচলিত। বলা হয়, কোন এককালে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক বাঙালি সাধু পুরীতে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। তাঁর বহুদিনের মনের বাসনা ছিল তিনি নিজের হাতে জগন্নাথদেবের জন্য ভোগ রান্না করে তাঁকে পরিবেশন করবেন। কিন্তু পুরী জগন্নাথ মন্দিরের তাঁর সেই কাজে বাধা দেয় সেখানকার মন্দিরের পাণ্ডারা। এই অপমান, কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তিনি আমরণ অনশনের পথ বেছে নিলে, তিনদিন পর জগন্নাথদেব তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দেন এবং ধ্রুবানন্দকে বঙ্গ দেশে ফিরলে দেশে যেতে বলেন। সাথে তিনি এই কথাও উল্লেখ করেন বঙ্গদেশে ভাগীরথী নদীর তীরে মাহেশ নামে একটি গ্রামে জগন্নাথদেব আগে থেকেই এক বিরাট দারুব্রহ্ম পাঠিয়ে রেখেছেন। সেটি কেটে তাঁদের তিন ভাই-বোনের মূর্তি গড়ে পুজো করার আদেশ দেন। এই স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পরেই ধ্রুবানন্দ পুনঃরায় মাহেশে ফিরে আসেন এবং মাহেশের ঘাট থেকে একটি নিম কাঠ পান; যেটি দিয়ে তিনি দেবতাদের মূর্তি বানিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকেই মাহেশের রথ ক্রমশ সনাতন হিন্দু ধর্মের বাঙালিদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
মাহেশের রথের কাঠামো
রথটি উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট, ওজন ১২৫ টনের কাছাকাছি। ২টি তামার ঘোড়া সহযোগে মোট ১২টি লোহার চাকার উপর রথটি দণ্ডায়মান।
মাহেশের রথ এবছর ৬২৫ বছরে পদার্পণ করলেও বর্তমানে করোনার আপদকালীন পরিস্থিতির জন্য এইবছরও এই বিখ্যাত রথযাত্রা স্থগিত রাখা হল।
আনুমানিক ১৭৪০ সাল থেকে স্বামী মধুসূদনানন্দ হাত ধরে গুপ্তিপাড়া রথযাত্রা প্রচলন হয়। তবে আর পাঁচটা রথের মত গুপ্তিপাড়ার রথকে জগন্নাথদেবের রথ বলা হয় না, একে বৃন্দাবন জীউর রথ বলা হয়।
কথিত আছে , একবার জগন্নাথদেবের সঙ্গে লক্ষ্মীর মনোমালিন্য হলে জগন্নাথদেব মাসীর বাড়িতেই থেকে যান। ফলে লক্ষীর মনে এক অদ্ভুত সন্দেহ বাসা বাঁধে। তাঁর মনে হয় জগন্নাথদেব হয়তো পরকীয়ায় লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু বৃন্দাবনে পৌঁছে লক্ষ্মী জানতে পারেন জগন্নাথদেব মাসীর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে নিয়েছেন। এরপরে স্বামীকে ফিরিয়ে আনার জন্য লক্ষ্মী তাঁর মাসীর বাড়িতে সর্ষে পোড়া ছিটিয়ে দেয়। কিন্তু তাতেও কোন কাজ না হলে, বৃন্দাবন ও কৃষ্ণচন্দ্র লোকজন নিয়ে মাসীর বাড়িতে হাজির হন। সেখানে পৌঁছে তাঁরা দেখেন বাড়ির তিনটি প্রবেশদ্বার বন্ধ। এদিকে লক্ষীর অনুরোধে তাঁর স্বামীকে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় তাঁরা দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করেন। প্রবেশের সাথে সাথে তাঁদের চোখে পরে ঘরের মধ্যে মালসায় নানা রকমের খাবারের পদ সাজানো রয়েছে। এরপর তাঁরা লোভ সংবরণ না করতে পেরে সেই সমস্ত মালসাগুলি লুট করে নিয়ে যায়। এরপর থেকেই উল্টো রথের দিন গুপ্তিপাড়া ভাণ্ডার লুট নামে একটি অনুষ্ঠান পালন করা হয়, যা ভারতবর্ষের আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না।
গুপ্তিপাড়ার রথের বর্ণনা-
রথের উচ্চতা ৩৬ ফুট। ভূমি ৩৪ ফুট × ৩৪ ফুট। রথটি নবরত্ন পদ্ধতি শৈলীতে সাজানো। এছাড়াও রথে ১৬টি চাকা রয়েছে।
২৪৩ বছরের পুরনো এই রথযাত্রা আজও সমানভাবে তার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। ১৭৭৬ সালে এই রথযাত্রার প্রচলন করেন মহিষাদল রাজপরিবারের ব্যক্তিবর্গরা।
রথের কাঠামো-
পূর্বে রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় যখন এই রথযাত্রা পালিত হতো তখন রথের ১৭টি চূড়া ছিল। চাকা উচ্চতা ৬ ফুট। তবে বর্তমানে রথের ১৩টি চূড়া দেখতে পাওয়া যায়।
তবে শুধু এই জায়গাগুলিতেই নয়, মায়াপুর ইসকনের রথ এবার ৫ কিলোমিটারের পরিবর্তে মাত্র ২০০ মিটার পথ অতিক্রম করবে। রথযাত্রা উপলক্ষ্যে কোনরকম মেলা বা উৎসব পালন করা হবে না বলে নদিয়ার মায়াপুর ইসকন মন্দিরের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। শুধুমাত্র পূজারী ছাড়া তেমন কেউ সক্রিয়ভাবে এই রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না এবং সম্পূর্ণ করোনার নিয়ম মেনেই রথ রাজপথ দিয়ে এগিয়ে চলবে।