“ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা”
বিখ্যাত কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়-এর লেখনীতে উঠে এসেছে আমাদের জন্মভূমি বসুন্ধরার কথা। আর এই বসুধার মৃত্তিকাকে যারা নিজের মাতৃরূপে পুজো করে চলেছে, আজ পরিচয় ঘটবে সেই সমস্ত মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে। মৃৎশিল্পের কথা উঠলেই যে জায়গার নাম সর্বপ্রথম সবার মুখে শোনা যায় সেটি হল কৃষ্ণনগর। কৃষ্ণনগরের তৈরি মাটির পুতুল এবং প্রতিমা শুধু দেশেই নয় বিদেশের মাটিতেও সমানভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল তৈরির উদ্ভব ইতিহাস:
জনৈক প্রফুল্ল কুমার সরকার ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ‘কৃষ্ণনগর রাজপরিবার’ নিবন্ধে লিখেছেন-
“কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলের আরম্ভ হইয়াছিল কৃষ্ণনগরের রাজার জন্য 'নরনারীকুঞ্জর' গঠন হইতে, নয়টি নারী পুতুলের সমষ্টিতে গড়া হইয়াছিল এই অদ্ভুত পুতুল। বিখ্যাত মৃৎশিল্পী যদুনাথ পালের পূর্বপুরুষ গোপাল পাল ইহার স্রষ্টা।”
নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহরের মৃৎশিল্প পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম একটি কুটির শিল্প। শোনা যায় নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমলে এই শিল্পের সূচনা হয়। সেই সময় বাংলাদেশের নাটোর থেকে মৃৎশিল্পীরা এসে মাটির পুতুল নির্মাণ করতে শুরু করেন (মতান্তর)। এরপরে আস্তে আস্তে এই সমস্ত মৃৎশিল্পীরা কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। তারপরেই এই শিল্প ব্যাপকতা লাভ করে এবং ক্রমেই তা বিশ্বের দরবারে ছড়িয়ে পড়ে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর বংশের উত্তর-পুরুষেরা কৃষ্ণনগরে বারো মাসে তেরো পার্বণের ঐতিহ্যে নানা দেবীমূর্তি গঠন করতে শুরু করেন। বিশেষ করে দুর্গা ও জগদ্ধাত্রীর মূর্তি তৈরিতে রাজপরিবারের মৌলিকতা লক্ষ করা যায়।
১৯৭১ সালে আনুমানিক ৩০০ জন কুম্ভকারদের নিয়ে কৃষ্ণনগর শহরের পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে জলঙ্গী নদীর তীরে অবস্থিত ঘূর্ণিতে মৃৎশিল্পীদের উপনিবেশ গড়ে ওঠে। এছাড়াও এই শহরের ষষ্ঠীতলা, কুমোরপাড়া, নতুনবাজারের মৃৎশিল্পীদের বসবাস দেখতে পাওয়া যায়। মূলত বলা হয়,জলঙ্গী নদী তীরের মাটি সংগ্রহ করে এই সমস্ত মৃৎশিল্পীরা বছরের পর বছর ধরে তাদের হাতের সূক্ষ্ম কারুকার্য ও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় রেখেছেন, যা কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলকে এনে দিয়েছে জগৎজোড়া সম্মান।
তবে কৃষ্ণনগর মৃৎশিল্পের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত রয়েছে। প্রথম হল ঘূর্ণি,যেখানকার শিল্পীর দক্ষতা প্রধানত পুতুল নির্মাণ এবং দেবদেবীর মূর্তি গঠন ও ভাস্কর্যের জন্য। দ্বিতীয়, কুমোরপাড়া ও ষষ্ঠীতলা। এই জায়গায় ছাঁচের ছোট ছোট পুতুল তৈরি করা হয়। আর সর্বশেষ যে জায়গার কথা বলা হবে তা হল রাজবাড়ির কাছাকাছি নতুনবাজার অঞ্চল। এরা প্রধানত মূর্তিশিল্পী হিসেবে পরিচিত। তবে হাঁড়ি কলসি গড়ার কুমোর সম্প্রদায়ের মানুষজন কৃষ্ণনগরের আশেপাশে বসবাস করেন।
১৮৮৮ সালে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের সম্পর্কে ভারতীয় যাদুঘরের সহকারী অবেক্ষক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “Krishnagar modellers belong to the Hindu Caste of Kumars, or Potters, one of the nine artisan classes of Bengal, whose rank stands just beneath the Brahmans and Writers. From time immemorial the occupation of the caste has been to make earthen vessels, and the figurative representations of devine manifestations described in sacred books.”
অর্থাৎ এখান থেকেই বোঝা যায় কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা প্রথমে দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন এবং পরবর্তীতে জীবন্ত আদর্শের পুতুল করার কৌশল রপ্ত করেছিলেন।
পুতুল তৈরির উপকরণ ও বৈশিষ্ট্য:
• এই স্থানে মাটির পুতুল তৈরির জন্য প্রথমে বেলে ও দো-আঁশ মাটির মিশ্রন তৈরী করে নেওয়া হয়। তার সঙ্গে পরিমাণমত এঁটেল মাটিও মেশানো হয়।
• এই তিন রকমের মাটি মেশানোর জন্য চটচটে হয়ে মাটি হাতে লেগে যায় না, ফলে সূক্ষ্ম কাজের সুবিধা হয়।
• এই স্থানের মাটি খুব পরিষ্কার হয়। পাথর, কাঁকর থাকে না এবং রঙ খুব সুন্দর হয়। তাই মূর্তি নির্মাণের পর দেখতেও অপূর্ব লাগে।
• মূর্তি নির্মাণের জন্য প্রয়োজনে বেলে মাটি ও উইয়ের ঢিবির মাটির এক সঙ্গে মেশানো হয়।
• ছোট ছোট মূর্তির হাত-পা গঠনের জন্য মাটির সঙ্গে তুলো দেওয়া হয়।
• কৃষ্ণনগর শহরের মৃৎশিল্পীরা রাজমহলের মাটি দিয়ে কাজ করে থাকেন।
• মৃৎশিল্পের এই সূক্ষ্ম শৈলী কৃষ্ণনগর ব্যতীত কোনও জায়গায় লক্ষণীয় নয়।
• ছাঁচের পুতুল ছাড়াও হাত দিয়ে তৈরি করা টিপিকাল বাস্তববাদী পুতুল গড়ার কৌশল একমাত্র কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়।
• কৃষ্ণনগরের পুতুল কোনও সামগ্রিক শিল্পী সমাজের সঙ্গত আত্মপ্রকাশ নয়।
[ তথ্যসূত্র:- কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প ও মৃৎশিল্পী সমাজ - সুধীর চক্রবর্তী ]
কিছু বিশিষ্ট মৃৎশিল্পীর পরিচয়:
কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল তৈরির পিছনে যাঁদের অবদান সবথেকে বেশি, সেই সমস্ত মৃৎশিল্পীরা বংশ পরম্পরায় আজও তাঁদের কাজ করে চলেছে। শুধু তাই নয়, তাঁদের তৈরী এই অমূল্য সৃষ্টিগুলো কিন্তু নিজের মাতৃভূমিতে নয়, গোটা বিশ্বের দরবারে আন্তর্জাতিক স্তরে সম্মানে ভূষিত হচ্ছে। এদের মধ্যে বেশ কিছু জনের কথা না বললেই নয়। মৃৎশিল্পী স্বর্গীয় বীরেন পাল, আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত সুবীর পাল, শংকর সরকার, তড়িৎ পাল, স্বর্গীয় কার্তিক চন্দ্র পাল এবং তাঁর বংশধর গৌতম পাল এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ক্রমাগত নিজের শৈল্পিক সত্ত্বাকে ব্যবহার করে চলেছেন।
গন্তব্যস্থলে পৌঁছনোর পথনির্দেশ:
১. হাওড়া থেকে প্রথমে শিয়ালদা স্টেশন আসতে হবে এবং শিয়ালদা থেকে কৃষ্ণনগর লোকাল এর চেপে কৃষ্ণনগর স্টেশনে নামতে হবে।
২. স্টেশন থেকে টোটো করে ঘূর্ণি পুতুলপট্টিতে আসা যায়।
৩. আবার বাসে করে বাসস্ট্যান্ডে এসে সেখান থেকেও টোটো ভাড়া করে ঘূর্ণিতে পৌঁছানো যায়।
মৃৎশিল্পের বর্তমান অবস্থা:
মাটির সঙ্গে মৃৎশিল্পীদের সম্পর্ক অনেকটা মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাড়ির টানের মত, যা কখনই কোনদিনও বিচ্ছিন্ন করা যায় না। তবে বর্তমান পরিস্থিতির প্রভাব যেমন সর্বত্র দেখা গিয়েছে, তেমনই মৃৎশিল্পের ক্ষেত্রেও তার কোনও অন্যথা ঘটেনি। কৃষ্ণনগরের এই মৃৎশিল্প গড়ে উঠেছে কিন্তু বংশপরম্পরায় পূর্বপুরুষদের হাত ধরেই।
তবে সভ্যতার ক্রমবর্ধমান রূপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে এই শিল্পেও কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়েছে। আর সেই জন্য সেই কাজ শিখতে উত্তরসূরিদের যেতে হয়েছে দেশ-বিদেশে। এর পেছনে সব চেয়ে বড় কারণ হল স্থানীয় জায়গায় অর্থাৎ কৃষ্ণনগরে কোন ভাল আর্ট কলেজ গড়ে না ওঠা। তাই মৃৎশিল্পীদের মতে যদি এই স্থানে একটি ভাল কলেজ বা কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হয়, তাহলে হয়তো কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল শুধু তার ঐতিহ্যে নয় তার গরিমাও ফিরে পাবে। আর এর সঙ্গেই বহু মানুষজন ও তাদের পরিবারের বিভিন্ন সদস্যরাও এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে।