উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুন হিমালয় অঞ্চলটি মূলত দেবভূমি হিসেবে পরিচিত । এখানে পুঞ্জিভূত তুষারের আবরণে হিমালয়ের দৃশ্য, মায়াবিনী প্রকৃতির রূপসজ্জা এইগুলির মধ্যে একটা দৈবিকতার মূর্ছনা অনুভব করা যায় । একটু ভাল করে খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন প্রকৃতি এবং দৈবিকতা এই দুই বিষয়ের মধ্যে একটা অন্তরবর্তী যোগসূত্র রয়েছে । খালি চোখে সেটা দেখা না গেলেও এই যোগসূত্রকে উপভোগ করা যায় । প্রকৃতি এবং দৈবিকতাকে অনুভব করতে চাইলে কাজের ফাঁকে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে পৌঁছে যান নৈনিতাল ।
অবস্থান - সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৩৫৮ ফিট উচ্চতায় কুমায়ুন হিমালয়ের পাদদেশে দেরাদুন শহর থেকে ৩৪৫কিমি অদূরে অবস্থিত শৈলশহর নৈনিতাল ।
শৈলশহর নৈনিতালের ইতিহাস সম্পর্কিত কিছু ঐতিহাসিক তথ্য -
দশম শতকে কাত্যুরী সম্রাজের পতনের পরে কুমায়ুন অঞ্চলটি কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত হয় । সেই সময় কুমায়ুনের নৈনিতাল শহরটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন খাসিয়া পরিবার । তবে কাত্যুরী সম্রাজের পতনের পরে চান্দ্ সাম্রাজ্য কুমায়ুন অঞ্চলে রাজত্ব শুরু করেন । এই চান্দ্ সাম্রাজ্য এর অন্যতম প্রধান রাজা ত্রিলোক চান্দ্ ১৩ শ শতকে ভীমতালে একটি ফোর্ট নির্মাণ করেন । তবে এই সময়ে সমগ্র নৈনিতাল চান্দ্ সাম্রাজ্য এর অন্তর্ভূক্ত ছিল না। এরপর ১৪৩৩ সাল এবং তার পরবর্তী সময়ে চান্দ্ সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ নৈনিতাল অঞ্চলে রাজত্ব শুরু করেন ।
পরবর্তীকালে ১৮১৪- ১৬ অ্যাংলো- নেপাল যুদ্ধের পরে ইংরেজরা সমগ্র ভারতের মতো কুমায়ুন অঞ্চলেও শাসন শুরু করেন । ১৮৪১সালে ইংরেজ শাসনের তত্ত্বাবধানেই নৈনিতাল শৈল শহরের উৎপত্তি ঘটে।
নৈনিতালের পৌরাণিক কাহিনি -
পুরানে বর্ণিত কাহিনী অনুসারে ৫১টি শক্তিপীঠের অন্যতম পীঠ হল নৈনি লেক । আমরা সকলেই জানি বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্রের সাহায্যে সতীকে ধ্বংস করেন । সেই সময় ভগবান শিব দুঃখে কাতর হয়ে সতীর মৃত শরীর নিয়ে সমগ্র জগৎ ঘোরেন, ফলে সতীর দেহের অংশবিশেষ পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে পতিত হয় । মানুষের বিশ্বাস সতীর দেহত্যাগের পর সতীর চোখ বা নয়ন এই নৈনি লেকে পতিত হয় । তাই এখানে নয়না দেবী মন্দির ও স্থাপন করা হয় । লেকের দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত এই মন্দিরটি স্থানীয় মানুষের কাছে নৈনি মাতা মন্দির হিসেবেই পরিচিত ।
দর্শনীয় স্থান -
১.নৈনি লেক-
নৈনিতাল নামের পিছনে মুখ্য কারণ হলো নৈনি লেক। স্বচ্ছ জলে পরিপুষ্ট এই লেকটি সমগ্র কুমায়ুন অঞ্চল জুড়ে বেশ পরিচিত ।এই লেক কে কেন্দ্র করে রয়েছে সাতটি পাহাড়ের চূড়ার অবস্থান ।এগুলি হল- আয়ার্পাতা, দেওপাতা, হান্ডি বান্ডি, চিনা পিক, আলমা, লারিয়া কান্তা, শের কা ডান্ডা । এই লেকটি মূলত দুইটি খন্ডে বিভক্ত, যার উত্তরের অংশটি মল্লিতাল এবং দক্ষিণের অংশটি তাল্লিতাল নামে নামকরণ করা হয়েছে । পর্যটনের উদ্দেশ্যে এই নৈনি লেকে বোটিং করার সুব্যবস্থা রয়েছে ।
নৈনিতাল শহরটি কিন্তু একটি বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র হিসেবেও পরিচিত । পুরাণের ৫১টি শক্তিপীঠের অন্যতম পীঠের নিদর্শন হলো এই নৈনি দেবী মন্দির। এই মন্দিরের গর্ভগৃহে স্থাপিত আছেন নৈনি দেবী । এছাড়াও এই মন্দিরে দেবী কালী এবং ভগবান গণেশের মন্দির রয়েছে ।
নৈনিতালের স্নো ভিউ পয়েন্ট থেকে হিমালয়ের একটা অসাধারণ দৃশ্য এর সাক্ষী থাকতে পারেন । দুধ সাদা তুষারে আবৃত শৃঙ্গ এর সাথে সাদা মেঘের সাথে একাত্ব হয়ে যাওয়ার মায়াবী দৃশ্য কখন ও প্রত্যক্ষ করছেন? যদি আপনার উত্তর নেতিবাচক হয় তাহলে প্রকৃতির এই লীলাখেলা দর্শনের জন্য নৈনিতাল ভ্রমণের প্ল্যান করে ফেলুন । এই স্নো ভিউ পয়েন্ট থেকে আপনি নন্দাদেবী, ত্রিশূল এবং নন্দা কোট শৃঙ্গ এর দেখা পেতে পারেন ।
নৈনিতালের মল্লিতাল অঞ্চলে অবস্থিত এই কেভ গার্ডেনে বিভিন্ন পশুদের শারীরিক আকৃতি সমান মোট ৬টি গুহা রয়েছে ।এছাড়াও এই গুহা গুলি একটির সাথে আর একটি সংযুক্ত ।এই কেভ নির্মাণের মুখ্য উদ্দেশ্যে হল হিমালয়ের জীবদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে পর্যটকদের একটা সূক্ষ্ম ধারণা প্রদান করা ।
নৈনিতালের বিখ্যাত পর্যটনস্থল হলো টিফিন টপ। এই স্থানটি থেকে নৈনিতাল সহ সমগ্র কুমায়ুন অঞ্চলের একটা সুন্দর দৃশ্যপট দর্শন করা যায় । শাল, ওক, দেবদারু গাছের সমন্বয়ে গঠিত এই স্থানটি শুধুমাত্র কুমায়ুন অঞ্চলই নয়,আবহাওয়া উপযুক্ত থাকলে এখান থেকে নন্দাদেবীর ও দর্শন পেয়ে যেতে পারেন । এই টিফিন টপ স্থানটি দরথি সিটস নামে ও পরিচিত ।
এছাড়াও নৈনিতালে নীম কারোলি বাবা আশ্রম, ভীমতাল, চিড়িয়াখানা, মল রোড দর্শন করে নিতে পারেন ।
কখন যাবেন?
নৈনিতালে বছরের যে কোনো সময় ভ্রমণ করে আসতে পারেন । এখানে বছরের সব সময় আবহাওয়া মনোরম থাকে ।তবে পর্যটকরা নৈনিতাল ভ্রমণের জন্য মে -জুন মাসটিকে বেছে নেনে । শীতের সময় এখানে তুষারপাতের সম্ভাবনা থাকে, তাই রোমান্টিক সময় কাটাতে শীতকালে ও নৈনিতাল ভ্রমণ করতে পারেন ।
কোথায় থাকবেন?
অনলাইনে হোটেল সার্চ করে বুকিং করতে পারেন । হোটেলের খরচ ১৫০০ টাকা থেকে শুরু ।
কীভাবে যাবেন?
বিমানে - কলকাতা বিমানবন্দর থেকে ভায়া নিউ দিল্লি বা মুম্বাই হয়ে পৌঁছে যান পান্থনগর বিমানবন্দর । সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে ৭০কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যান গন্তব্যে ।
ট্রেনে - হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে পৌঁছে যান কাঠগোদাম স্টেশন । স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে ৩৫কিমি দূরত্ব অতিক্রম পৌঁছে যান নৈনিতাল।