ভারতবর্ষের তথ্যপ্রযুক্তি বিদ্যা, বাণিজ্য, মহাকাশ চর্চা, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পর্যটন এবং ঔষধপত্রের বিদ্যা সংক্রান্ত প্রধান কেন্দ্র হল উত্তর প্রদেশ রাজ্যের রাজধানী লখনৌ। শুধু তাই নয়, খাঁটি কাবাব এবং বিরিয়ানির জন্যও লখনৌ সমানভাবে জনপ্রিয়। তবে এই সবকিছুর মধ্যেও লখনৌর ঐতিহ্য হল বাড়া ইমামবাড়া; যার ইতিহাস আজও বহু ভ্রমণপ্রেমীর অজানা। আর এই অজানা ইতিহাসের মধ্যে লুকিয়ে আছে স্থাপত্য-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মেলবন্ধন।
লখনৌ শহরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল এই বাড়া ইমামবাড়া, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে শহরের ঐতিহ্য সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যের নিদর্শন। নবাব আসাফ-উদ-দৌলার শাসনকালে এটি নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে নবাব প্রয়াত হলে তাঁকে সমাধি দেওয়া হয় এই ইমামবাড়ার একটি অংশে; যেটি আসাফি ইমামবাড়া নামে বিখ্যাত। বর্তমানে মুসলিম সম্প্রদায় শিয়া আজাদারি বা মুহররামের জন্য এটি জায়গাটি ব্যবহার করা হয়।
বাড়া ইমামবাড়ার ঠিক পূর্ব দিকে রয়েছে শাহী বাওলি, যার চারপাশে রয়েছে বড় বড় বিল্ডিং এবং মাঝখানে রয়েছে একটি অদ্ভুত কূপ। ভূগর্ভস্থ নদীর জলের স্রোতের সঙ্গে এই কূপটির যোগাযোগ ছিল। তাই সারা বছর এখানে জল থাকত। আভ্যন্তরীণ বিল্ডিংটি পাঁচতলা, ইংলিশ মার্বেল দিয়ে গঠিত। ভিতরে রয়েছে ছোট্ট একটি ঠান্ডা গরম জলের ঝর্ণা। দেওয়ালের গায়ে রয়েছে বিভিন্ন রকমের নকশা। নবাব এবং তাঁর সভা পারিষদগণ এই জায়গা থেকে গোটা প্রাসাদের চারিদিকে নজর রাখতেন। কারণ অভ্যন্তরীণ কূপের জলে অপর প্রান্ত দিয়ে আগত ব্যক্তিদের প্রতিচ্ছবি দেখা যেত। তাই অনেকেই মনে করেন এটি নবাবের লাইভ সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। তবে সম্পন্ন জায়গাটি অক্ষত না থাকলেও কিছু কিছু স্মৃতি আজও রয়ে গিয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন পর্যটক নিজেকে সৌভাগ্য পরীক্ষা করার জন্য এই জলে অনেক সময় মুদ্রা নিক্ষেপ করেন।
বাড়া ইমামবাড়ার সবথেকে আকর্ষণীয় জায়গা হল এই ভুল ভুলাইয়া। এখানে ১০২৪টি প্রবেশ পথ রয়েছে; যেগুলির কোন একটি দিয়ে আপনি ঢুকতে পারবেন। তবে বেরোনোর পথ মাত্র ২টি। তাই বহু মানুষ এখানে এসে হারিয়ে যান। এই গোলকধাঁধার জায়গাটি ইমামবাড়ার একদম শীর্ষে অবস্থিত। ছোট ছোট অন্ধকার একাধিক সিঁড়ি অতিক্রম করতে করতে কখন খোলা বারান্দার ছাদে পৌঁছে যাবেন তা বুঝতে পারবেন না।
এই প্রকল্পটির করে ওঠার রহস্য-
১৭৮৪ সালে একবার আওয়াধ অঞ্চলে একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে অনাহারের কারণে মানুষ অসহায় ও রোগগ্রস্ত হয়ে পরতে থাকে। এইসময় নবাব আসাফ-উদ-দৌলা এই সমস্ত অনাহার পীড়িত মানুষদের নিয়ে এসে এই স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণে তাদের নিযুক্ত করেন। দীর্ঘদিন কাজটি চলার ফলে বহু মানুষ নিশ্চিতভাবে তাদের সংসার চালায়। অনুমান করা হয় সেই সময় প্রায় ২০০০ শ্রমিক এই কাজে নিযুক্ত ছিলেন।
নবাব আসাফ-উদ-দৌলার সমাধি
বাড়া ইমামবাড়ার প্রাঙ্গণের পশ্চিম দিকে রয়েছে আসাফী মসজিদ। এই মসজিদে রয়েছে নবাবের সমাধি, যা মুঘল সাম্রাজ্যে এক রূপকথার স্থাপত্য চিহ্ন।
স্থাপত্যরীতির অদ্ভুত নির্মাণকার্য-
এই স্মৃতিস্তম্ভটি বারংবার পর্যটকদের মনে এক অদ্ভুত দোদুল্যমান অবস্থার সৃষ্টি করে। প্রথমত কোন কাঠের কাজ ছাড়াই এই পুরো স্তম্ভটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, আভ্যন্তরীণ গ্যালারিগুলিতেও এই একই জিনিস দেখতে পাওয়া যায়। ভাবলে অবাক লাগে কোনরকম কাঠ ছাড়া শুধুমাত্র কিছু ধাতব স্তম্ভ এবং তার সংযোগে এই বিল্ডিংগুলি করে গড়ে তোলা হয়েছিল।
আর পাঁচটা ফরাসি বা মুঘল সাম্রাজ্যের স্থাপত্য শিল্পের মতো নয়। এটিতে কোন প্রকার গম্বুজ বা মিনার নেই। বেশির ভাগটাই ধনুকাকৃতি খিলান আর জানালা দ্বারা নির্মিত।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অবমাননা-
কেন্দ্রীয় হলটি বিশ্বের বৃহত্তম ভল্ট চেম্বার হিসেবে বিখ্যাত, যা পদার্থবিজ্ঞান এবং মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সংক্রান্ত সমস্ত কিছুকে অস্বীকার করে। হলটির মধ্যে কোন জায়গায় কোনরূপ কড়িকাঠ বা বিম দেখতে পাওয়া যায় না। তাই এটি পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম একটি বিস্ময়কর স্থাপত্য।
তাহলে বুঝতে পারছেন তো কেন সেই যুগের স্থাপত্য শিল্পের নমুনা আজও আমাদের চমক লাগাচ্ছে, এবং বিজ্ঞানও যেখানে হার মানছে। কী গল্প শুনে এবার যেতে ইচ্ছা করছে তো? চিন্তা নেই! তার জন্য নীচে দেওয়া রইল এই জায়গার ঠিকানা-
মাচ্ছি ভবন, লখনৌ, উত্তর প্রদেশ - ২২৬০০৩