‘তুঙ্গনাথ' শব্দের অর্থ হল ‘শৃঙ্গ কুলের দেবতা'। ‘পঞ্চকেদারের'(কেদারনাথ, মদমহেশ্বর,তুঙ্গনাথ,কল্পেশ্বর এবং রুদ্রনাথ ) মধ্যে তৃতীয় কেদার তুঙ্গনাথ উত্তরাখণ্ড রাজ্যের রুদ্রপ্রয়াগ জেলায় অবস্থিত। এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ শিবমন্দির হিসেবে বিখ্যাত। যার উচ্চতা প্রায় ১২০৭৩ ফুট। মন্দাকিনী এবং অলকানন্দা নদীর উপত্যকার উপর অবস্থিত তুঙ্গনাথ।
তুঙ্গনাথ মন্দিরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য:
পৃথিবীর সর্বোচ্চ এই শিবমন্দির চন্দ্রশিলা শিখরের কোলে তুঙ্গনাথ পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত। গ্রানাইট পাথর দিয়ে তৈরি মন্দিরটির গঠন অনেকটা কেদারনাথের মতো। মন্দিরের গায়ে রয়েছে সুন্দর কারুকার্য আর চূড়াতে তামার পাতের উপর সোনার প্রলেপ দেওয়া অংশ। সামনের বাঁধানো অংশের এক পাশে আছেন পঞ্চ ঈশ্বরী মাতা, ভগবান বিষ্ণু, গৌরীশঙ্কর পিতৃদেব,ভৈরবনাথ।গর্ভমন্দিরের ভেতর রয়েছে লিঙ্গ মূর্তি এবং মূর্তির পিছনে আছে শঙ্করাচার্যের তৈলচিত্র, বাঁদিকে আছে কালভৈরব এবং ডান দিকে আছে ঋষি বেদব্যাস। মন্দিরের সামনে রয়েছে নন্দী মূর্তি।কেদারনাথের মন্দিরে রাওয়াল ব্রাহ্মণরা পুজো করলেও, শঙ্করাচার্যের সময়কাল থেকে এখানে দক্ষিণ ভারতীয় লিঙ্গায়েত ব্রাহ্মণরা পুজো করে থাকেন। তুঙ্গনাথের উপরে ১৩১২৩ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রশিলা অবস্থিত; যেখান থেকে হিমালয়ের ৩৬০ ডিগ্রি কোণে চারপাশে চৌখাম্বা, নন্দাদেবী, নন্দাঘুণ্টি, পালকি, কামেট, নীলকণ্ঠ, সুদর্শন, মেরু-সুমেরু, শিবলিঙ্গ প্রভৃতি তুষারধবল শৃঙ্গ দেখা যায়।
প্রাচীন এই মন্দিরের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
কথিত আছে, মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভ্রাতৃহত্যার পাপ মোচন করতে পাণ্ডবরা শিবের পুজো করার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর তাঁরা পুজোর জন্য বারাণসীতে গিয়ে উপস্থিত হলেও দেবাদিদেব মহাদেবের দর্শন পান না। মহাদেব পাপীদের হাতে ধরা দেবেন না বলে মহিষরূপ ধারণ করেন এবং হিমালয় পর্বতমালার উত্তরাখণ্ডের গুপ্তকাশীতে গিয়ে লুকিয়ে পরেন। পাণ্ডবরা তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে উত্তরাখণ্ডে এসে পৌঁছলে মহাদেব এ-পাহাড় থেকে ও-পাহাড় পালিয়ে বেড়ান। পাণ্ডবরাও তাঁর পিছু ধাওয়া করলেও তাঁকে ধরতে অসমর্থ হন। কিন্তু কোনও কোনও স্থানে তাঁরা মহিষরূপী মহাদেবের লেজ, শিং স্পর্শ করতে পেরেছিলেন। আর ঠিক এরপর থেকেই স্পর্শিত অংশের স্থানগুলি "পঞ্চকেদার" নামে পরিচিত হয়।
তৃতীয় কেদার তুঙ্গনাথে মহাদেবের 'বাহু' পতিত হয়। পুরাণ অনুযায়ী, তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়। কিন্তু পরবর্তীতে শঙ্করাচার্য নতুন করে এই মন্দির আবার নির্মাণ করেন এবং তিনিই প্রথম মন্দিরে নিয়মিত পুজোর প্রচলন করেন। এই মন্দিরে মহিষরূপী শিবের মস্তকের অংশ পূজিত হয়। এছাড়াও জানা যায় শিবের বর পেতে লঙ্কাধিপতি রাবণ তুঙ্গনাথে এসে তপস্যা শুরু করেছিলেন। আবার রাবণকে বধ করে রামচন্দ্র চন্দ্রশিলা শিখরে তপস্যা করেন।
গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর পথনির্দেশ:
তুঙ্গনাথ মন্দিরে পৌঁছনোর জন্য প্রথমে হাওড়া থেকে ট্রেনে হরিদ্বার পর্যন্ত যেতে হবে। তারপর গাড়ি করে সেখান থেকে উখিমঠে পৌঁছতে হবে। সেখানে চাইলে এক রাত কাটিয়ে পরের দিন সারিগ্রাম থেকে হাঁটা পথে দেওড়িয়াতাল পৌঁছে রাত কাটিয়ে,পরদিন সকালে সেখান থেকে চোপতায় পৌঁছে সাড়ে তিন কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ার পিঠে চড়ে পৌঁছে যাওয়া যায় তুঙ্গনাথ মন্দিরে। প্রবেশদ্বারে ঘণ্টা বাজিয়ে যাত্রাপথের শুরু হয়।
যাত্রাপথের বর্ণনা:
যাত্রাপথে চোপতার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অভূতপূর্ব। ছোট জনপদ চোপতার এক প্রান্তে রয়েছে সবুজ উপত্যকা ভূমি। যার তুলনা একমাত্র 'ইউরোপের সুইজারল্যান্ডের' সঙ্গেই করা হয়। সবুজাবৃত চোপতার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৯০০০ ফুট। চোপতা থেকে তুঙ্গনাথ মন্দিরের পথ খুব বেশি চড়াই-উৎরাই। সেই ছায়া সুনিবিড় পথ দিয়ে মোটামুটি এক কিলোমিটার যাওয়ার পর দেখা যায় ঘন সবুজ 'বুগিয়াল'। যার অপরূপ শোভা সর্বদা আগত পর্যটকদের আকর্ষণ করে চলেছে।
এই স্থানে বেশকিছু টেন্ট দেখতে পাওয়া যায়;যেগুলির মধ্যে স্থানীয় বাসিন্দারা এবং পর্যটকেরা কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নেয়। পথের দু'ধারে সবুজ বনানী রডোডেনড্রন গাছ আছে। এছাড়াও পাইন,ওক,ম্যাপেল, উইলোর ঘন জঙ্গল দেখতে পাওয়া যায়। বুগিয়ালের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে পর্যটকেরা তুঙ্গনাথ দর্শনের এগিয়ে চলে। পথে অনেক সময় একটু অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। যাত্রাপথ যেহেতু খুব বেশি চড়াই; তাই এই পথে হেঁটে মন্দিরে করাই করায় শ্রেয়।
জলবায়ু পরিবর্তন:
পার্বত্য এলাকার মতো এখানেও শীতলতা অনুভূত হয়। শীতকালে বেশ ঠান্ডা পড়ে, তাপমাত্রা ক্রমশ নিম্নগামী হয় এবং তুষারপাত দেখতে পাওয়া যায়। তাই এই সময় অর্থাৎ কালীপুজোর প্রায়ই পরপর শীতকালে ছ'মাস মন্দির বন্ধ থাকে। তখন দেবতার পুজো করা হয় 'মুকুমঠে'। তবে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা প্রায় ১৬ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকে। এই সময় অর্থাৎ মে থেকে নভেম্বর মাসে দেবতাকে ফিরিয়ে নিয়ে আনা হয় মন্দিরে। অক্টোবর মাসের দিকে ঠান্ডার পরিমাণ অনেক কম থাকে,তাই অক্টোবর মাসই ভ্রমণের উপযুক্ত সময় বলে ধরে নেওয়া হয়।
রাত্রিযাপনের সুব্যবস্থা:
তুঙ্গনাথে সেভাবে থাকবার জন্য কোনও সুব্যবস্থা নেই। এখানে পাহাড়ের কোলে মন্দির কমিটির গেস্টহাউজ রয়েছে,যা আয়তনে খুব বড় না হলেও; মাথা গোঁজার জন্য যথেষ্ট। তবে খাদ্যতালিকায় তেমন কোনও সুস্বাদু খাবারের স্বাদ পাওয়া যাবে না। জোয়ার-বাজরা আর সামান্য একটু আটার রুটি সাথে রাজমা, মটর আর কিছু শাক সবজির তরকারি পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে ভাল এবং সহজ পন্থায় যেটি পাওয়া যায় সেটি হল খিচুড়ি আর আলু ভাজা। তাই এই মন্দির প্রাঙ্গণে এসে এটি সবথেকে সুস্বাদু এবং সুখাদ্য বলে সবাই ভক্ষণ করে থাকেন।
উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান:
তুঙ্গনাথ ছাড়াও এখানে চোপতা, সারিগ্রাম, গোপেশ্বর দেওড়িয়াতাল প্রভৃতি বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যা খুব সহজেই আপনার মনোরঞ্জন করবে। এই স্থানে উদ্ভিদবিদ্যা সংক্রান্ত "গাড়োয়াল বিশ্ববিদ্যালয়" এবং কেদারনাথ শৃঙ্গের বিপরীতে, মন্দিরের উচ্চতায় পর্বতের কোলে 'দুগালিবিত্ত' নামে একটি বিশ্রামাগার আছে। এছাড়াও কেদারনাথে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের অভয়ারণ্য দেখতে পাওয়া যায়। যা কস্তুরী হরিণের অভয়ারণ্য নামে পরিচিত। তবে ১৯৭২ সাল থেকে বিপন্ন কস্তুরী হরিণগুলির সংরক্ষণ করা হয় এবং তাদের প্রজনন স্থান হিসাবে নির্বাচন করা হয়েছে চোপতার 'খরচুলা খারাক'-কে।