ভারতের প্রাচীন শহরগুলির মধ্যে বারাণসী বা কাশী হল অন্যতম। তাই গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এই শহরটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম । তবে বারাণসী স্থানটি ধর্মস্থান হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত ।
অবস্থান
ভারতের প্রাচীন শহর বারাণসী বা বেনারস উত্তরপ্রদেশের রাজ্যের রাজধানী শহর লখনৌ ৩২০ কিমি দূরে অবস্থিত ।
বারাণসীর শহরের পৌরাণিক কাহিনি
হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী ত্রিলোকের প্রধান দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব এই তিন দেবতার মধ্যে ভগবান শিব বারাণসী শহরের নির্মাণ করেন। একদা ব্রহ্মা এবং শিবের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, সেই যুদ্ধে ব্রহ্মার পাঁচটি মস্তক থেকে একটি মস্তকছেদ করেন ভগবান শিব। যুদ্ধে জয়ী হয়ে ব্রহ্মার কাটা যাওয়া মস্তক হাতে নিজের জয় ঘোষণা করেন। ভগবান শিব এই সময়ে প্রায় সর্বদাই ব্রহ্মার মস্তকটি মুঠোবন্দি করে রাখতেন । কিছুদিন পর শিব যখন বারাণসীতে আসেন, হঠাৎ করেই তার মুঠোবন্দি ব্রহ্মার মস্তকটি মাটিতে পড়ে যায় এবং তৎক্ষণাৎ সেই মস্তকটি মাটি থেকে উধাও হয়ে যায় । এই ঘটনার পর থেকেই হিন্দু শাস্ত্রে বারাণসীকে পবিত্র স্থান হিসেবে মনে করেন হিন্দু ভক্তগণ ।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব -
১. বারাণসী শুধুমাত্র হিন্দু ধর্ম নয় বৌদ্ধ ধর্মের ও অন্যতম পীঠস্থান। খ্রীস্টপূর্ব ৫২৮ সালে বারাণসীর সারনাথে প্রথম ধর্মপোদেশ দেন।
২. খ্রীস্টপূর্ব ৬৩৫ সালে চৈনিক পর্যটক হিউএন সাং বেনারসের আসেন। সেই সময় এই শহরের সংস্কৃতি এবং ধর্ম তাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করে।
৩. ৮ম শতকে আদি শংকরাচার্য শিবের মন্দির নির্মাণ করেন।
৪. মধ্যযুগে বারাণসী চেরো সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।
৫. পরবর্তী কালে মোঘল রাজা আকবরের আমলে ও এই শহরের বিকাশ ঘটে ।
৬. এছাড়াও সিল্ক শিল্পের জন্য ও এই শহরের জনপ্রিয়তা রয়েছে ।
দর্শনীয় স্থান -
১. কাশী বিশ্বনাথ মন্দির
বেনারসের প্রধান দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম দর্শনীয় স্থানটি হল - বিশ্বনাথ মন্দির। মন্দিরটি হিন্দুদের প্রধান ধর্মস্থান হিসেবেও পরিচিত । বিশ্বনাথ মন্দিরের শিখরটি প্রায় ৮০০ কিলোগ্রাম সোনা দ্বারা নির্মিত । বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই মন্দিরটির স্থাপত্যশিল্পের অসাধারণ নিদর্শন । মন্দিরের গর্ভগৃহে স্থাপিত আছেন ভগবান শিব ।
২. রামনগর ফোর্ট
১৮ শতকে নির্মিত এই ফোর্টটি প্রধান শহর থেকে প্রায় ১৪ কিমি অদূরে অবস্থিত। এখানে আপনি প্রায় ১৫০ বছরের প্রাচীন অস্ত্রশস্ত্র, রাজাদের ব্যবহৃত হুক্কা, অলংকার এবং তৎকালীন প্রত্নতত্ত্ব এর সাক্ষী থাকতে পারেন। পরিশেষে ফোর্ট সংলগ্ন বেদব্যাসের মন্দির দর্শন করে নিতে পারেন।
৩. শ্রী দূর্গা মন্দির
আধ্যাত্বিকতায় পরিমন্ডিত শহর হলো বেনারস । তাছাড়াও শিব দর্শন করলে শক্তি দর্শন না করলেই নয় । তাই অসি ঘাট থেকে মিনিট পাঁচেক হেঁটে দর্শন করে নিন ৩০০ বছরের প্রাচীন শ্রী দূর্গা মন্দির ।
৪. বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়
এশিয়ার বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় গুলির মধ্যে অন্যতম হল বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা প্রসারে এবং ইতিহাসের দিক দিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি সকলের কাছেই পরিচিত।
৫.ধামেখ স্তূপ
বারাণসী থেকে ১৩কিমি অদূরে সারনাথে এই স্তূপটি অবস্থিত । পাথর ও ইট সহযোগে নির্মিত এই স্তূপটি ৪৩.৬ মিটার লম্বা। ঐতিহাসিকদের মতে এই স্তূপটি খ্রীস্টপূর্ব ২৪৯ সালে নির্মাণ করা হয় । বৌদ্ধধর্ম মত অনুযায়ী এই ধামেখ স্তূপে বসেই বুদ্ধদেব প্রথম ধর্মমত প্রদান করেন।
৬. কাল ভৈরব মন্দির
বেনারসের প্রাচীন শিবমন্দির গুলির মধ্যে কাল ভৈরব মন্দির অন্যতম । এখানে শিবের গলায় রয়েছে মুণ্ডমালা । স্থানীয় মানুষরা এই দেবতাকে শ্রদ্ধা করেন তেমন ভয়ও করেন। তাই এখানকার মানুষ বেনারসের বাইরে কোথাও গেলে দেবতার অনুমতি নিয়েই যান ।
৭.সংকটমোচন হনুমান মন্দির
অসিঘাটের নিকটে অবস্থিত এই মন্দিরে ভগবান রাম এবং হনুমান স্থাপিত আছেন ।
বেনারসের বিখ্যাত ঘাট সম্পর্কে কিছু তথ্য -
১. দশাশ্বমেধ ঘাট - বেনারস বলতেই যে ঘাটটির কথা প্রথমেই মাথায় আসে সেটি হল - দশাশ্বমেধ ঘাট। গঙ্গার প্রবহমানতা, সাধুদের যাতায়াত, ফুল বিক্রেতাদের কোলাহল, ঘাটের পাড়ে বাঁধা নৌকার ইত্যাদি দৃশ্যগুলো অনেকটা পটে আঁকা ছবির মতো । এছাড়াও সন্ধেবেলায় গঙ্গা আরতি দর্শনের জন্য এটি আদর্শ স্থান ।
২. অসি ঘাট - অসি ঘাটের প্রধান বিশেষত্ব হল - সয়ম্ভূ মোটা শিব । অসি ঘাটের রূপটা কিছুটা আলাদা । পর্যটকদের তেমন ভিড় না থাকায় এখানে বহু ধ্যানমগ্ন সাধুদের দেখা মেলে ।
৩. মণিকর্নিকা ঘাট - হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে এই ঘাটে দেহসৎকার হলে মোক্ষ লাভ করা যায় ।
৪. কেদার ঘাট - কেদারঘাটে ভগবান কেদারনাথ স্থাপিত আছেন । এখানে ভগবান শিবের নিত্য আরাধনা করা হয় ।
কী কী করবেন?
১. গঙ্গাবক্ষে নৌকা চেপে সম্পূর্ণ বেনারস দর্শন করে নিতে পারেন।
২. সন্ধেবেলায় মনোমুগ্ধকর গঙ্গা আরতি দেখে আপ্লুত হতে পারেন।
৩. বেনারস শহরের মধ্যে সূক্ষ আধ্যাত্মিকতা প্রলেপ রয়েছে, যা সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করতে পারে না। শোনা যায় বেনারসের ঘাটে ঘাটে শিব বর্তমান রয়েছেন । ইচ্ছা করলে সেই আদি দেবতাকে আপনি ও খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারেন।
৪. বেনারস মানেই বেনারসী শাড়ী এবং বেনারসী পান । তাই নিজের পছন্দ মতো শাড়ী কিনে নিতেই পারেন । আর বেনারসী পান ও চেখে দেখতে পারেন ।
৫. প্রাচীন ইতিহাসের পদধ্বনিকে কান পেতে শুনতে পারেন ।
কোথায় থাকবেন?
বেনারসে প্রচুর হোটেল রয়েছে । অনলাইনে সার্চ করে হোটেলের সন্ধান পেয়ে যাবেন । হোটেল ছাড়াও ধর্মশালা এবং মঠ রয়েছে, ইচ্ছাকরলে সেখানে ও থাকতে পারেন ।
কীভাবে যাবেন?
বিমানে - কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বিমান নিয়ে পৌঁছে যান লাল বাহাদুর শাস্ত্রী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর । বিমানবন্দর থেকে গাড়ি ভাড়া করে ২৬ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে ।
ট্রেনে - হাওড়া থেকে বেনারস যাওয়ার প্রচুর ট্রেন উপলব্ধ আছে । মাত্র ৯ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে ঘুরে আসতে পারেন এই প্রাচীন নগরীতে।