আমার জন্মদিনের মাত্র একমাস আগে হঠাৎ করে আমাকে মুম্বাই চলে যেতে হয়। প্রথম প্রথম মনে হয় জন্মদিনের মাস হয়তো একটু অন্যরকমভাবে এই বছরটা কাটবে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমি একদম সেইরকম ব্যক্তিদের মধ্যে পরি না, যারা জন্মদিন নিয়ে খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে পরে। আমি শুধু ভেবেছিলাম নতুন শহরে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে জন্মদিনটা হয়তো ভালোই কাটবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পরি। আর তাঁর জন্য জন্মদিনের সমস্ত পরিকল্পনায় জল ঢেলে যায়।
কিন্তু এরপর হঠাৎ করেই আমি সিদ্ধান্ত নিই আমার নিজের খুশির জন্য আমি কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসতে পারি। যেমন ভাবা তেমন কাজ দেরি না করে পরের বছরই আমি আমার জন্মদিন একাকী বালির সমুদ্রসৈকতে কাটায় এবং ঠিক এরপর কখনও পাহাড়ের খুব কাছে পৌঁছে যায়।
আমি আমার ২৫তম জন্মদিনের একটি ছোটগল্প আপনাদেরকে শোনাব। সেই বছর জন্মদিনে আমি আমার প্রিয় বন্ধুকে আমার সাথে ঘুরতে যাওয়ার জন্য রাজি করা এবং আমরা প্রথমে ডালহৌসি পৌঁছাই। আমি আমার বন্ধু ছোটবেলা থেকে কোনদিনও একা বাইরে যায় নি। কিন্তু এই প্রথম ২৫ বছর বয়সে বাইরে বেরিয়ে অনুভব করেছি আমরা কতটা বড় হয়ে গেছি।এছাড়া ঠিক গুটিপোকা থেকে প্রজাপতি হওয়ার গল্প।
সুতরাং প্রথমে আমরা দু’জনে একটু ঘাবড়ে যাই কোথায় যাব? কী করতে হবে? তবে সবশেষে হিমাচল প্রদেশের বসতি স্থাপন করি। গ্রীষ্মকালের মধ্যেও শীতল জলবায়ুর আভাস পাওয়া কিন্তু সত্যিই রমণীয়।
হিল স্টেশন হিসেবে ডালহৌসি বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু ওখানে পৌঁছে আমার জানা ডালহৌসি আরও বেশি সুন্দর মনে হল। টিকিট কেটে, হোটেল বুক করে যখন ডালহৌসির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম তখন আর পাঁচটা বন্ধুর ইনস্টাগ্রামে ছবি দেখে খুব একটা আকর্ষণীয় বলে মনে হয় নি। কিন্তু কী জানেন পৌঁছে তার সৌন্দর্য দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। আর সাথে এটাও বুঝতে পেরেছি ফটো হয়তো কখনও কখনও কোন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনা করতে পারে না।
ডালহৌসিতে পৌঁছে আমরা প্রধান গান্ধী চৌক থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে নির্জনতাপূর্ণ জোস্টেলে থাকতে শুরু করি। সত্যি বলতে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না যখন নিজের চোখের সামনে তুষারপাত দেখি। এতদিন শুধুমাত্র ল্যাপটপের স্ক্রিনে এই এরকম ওয়ালপেপার দেখে এসেছি।
সেদিন আমরা বেরিয়ে হোস্টেল থেকে সিটি সেন্টার গান্ধী চৌক পর্যন্ত হেঁটেছিলাম। ২০ মিনিট খোঁজাখুঁজির পর এখানকার খুব সুন্দর ডালহৌসি ক্যাফে খুঁজে পাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখানকার কফি আমাকে খুব হতাশা প্রদান করে ( কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমি এখানে আমার প্রিয় ক্যাফে মকলেওড খুঁজে পাই)।
আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম মাত্র ৫ কিলোমিটার পথ হাঁটলে আমরা ‘পাঁচপুলা’ নামক জলপ্রপাতটির খোঁজ পাবো। তাই সঙ্গে সঙ্গে আমরা বেরিয়ে পরলাম।
গন্তব্য স্থানে পৌঁছানোর রাস্তা মনোরম থাকায় আমাদের খুব একটা ক্লান্ত বোধ করতে হয় নি। পাঁচখোলা পৌঁছে সিঁড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকতে শুরু করলাম। আমরা ভেবেছিলাম হয়তো এই জলপ্রপাত নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মতো না হলেও কিছুটা তার সমতুল্য হবে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁরম, যা দেখলাম তা দেখে মনে হল কোন ব্যক্তি হঠাৎ করে ওয়াশরুমে ঢুকে কল বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছে।
তবে ওখানে পৌঁছে এক কাপ কফি, সাথে ম্যাগি খাওয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
যখন খাবারের কথায় উঠল তাহলে বল্ এখানে এসে একমাত্র কড়াই চিকেন খেয়েছিলাম। এখানকার অন্যতম জনপ্রিয় একটি রান্না, যা খেয়ে আমাদের মনে হয়েছিল যে একমাত্র কড়াই চিকেন খাওয়ার জন্য আমরা বহুদিন এই হোস্টেলে থেকে যায়।
আমার তোলা ছবিটা দেখে নিশ্চয়ই খুব লোভ লাগছে?
তবে সবকিছুর মধ্যে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল দৈনকুন্ড জোট ভ্যালি ট্রেক।
তবে আমি এবং আমার বন্ধুর কাছে ট্রেক ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ নতুন। কিন্তু আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ডালহৌসিতে থাকাকালীন আমরা একটি হলেও ট্রেক করব। তাই একটু খোলামেলা জায়গাতেই আমরা ঠিক করি ট্রেক করার। ( যদি আমরা কাউকে বুঝতে দিই নি যে ট্রেকের ব্যাপারে আমরা একেবারেই আনকোরা।)
হোটেলে থাকাকালীন দৈনকুন্ড ,জট ভ্যালি ট্রেকের নাম শুনে ভাবতাম এটি হয়তো খুব সহজ একটা কাজ। তাই ট্রেক করার আগ্রহও ছিল তুঙ্গে।
একটা সময়ের পর খেয়াল করলাম আমি আমাদের ৬ জনের ছোট্টো গ্রুপ থেকে একটু পিছিয়ে পরেছি। কিন্তু কোন কিছু না ভেবে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে আমি আবার এগিয়ে চললাম। কারন তখন আমার মন শুধু ছুটে চলেছে পাহাড়ের দিকে।
এরপর শুরু হল আমাদের হাঁটাপথ। ঘন জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে ধৌলাধর পরবর্তী যেন এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পরিষ্কার পথের মধ্যে দিয়ে গাইড বন্ধুসাথে খুব সহজেই পৌঁছে গেলাম। সঙ্গে শুনতে পেলাম নানা রকমের কাহিনী। কীভাবে ডাইনিরা এই পর্বতে গান গাইতেন এবং হঠাৎ করে দেবীর আবির্ভাব কীভাবে গ্রামকে রক্ষা করে তা সবই শুনতে লাগলাম। আর এরপর ডাইনির হাত থেকে গ্রামকে বাঁচানোর জন্যই ডাইনকুন্ডর শিখরে দেবী মন্দির স্থাপন করা হয়।
যাত্রাপথে আপনি বলতে পারবেন কেন এই জায়গাটিকে ‘দ্যা সিঙ্গিং হিল’ বলা হয়। বনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যখন বাতাসে গাছের পাতাগুলির শব্দগুলি এক অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্রের প্রতিধ্বনিত সৃষ্টি করে, তখন এই অনুভূতিটি আপনার হবেই। আমিও এই পরিবেশের মত্ততায় মত্ত হয়ে ‘দ্যা হিলস অলিভ’ গানটি গাইতে শুরু করেছিলাম।
ডাইনকুন্ড থেকে জট উপত্যকা পৌঁছাতে আমাদের সময় লাগে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা। কিছুটা হাঁটার পরে এক জায়গায় বসে একটু বিশ্রাম নিলাম আবার একটি ছবি তুললাম তারপর আবার হাটা শুরু করলাম। একটা জায়গায় শিলাবৃষ্টি দেখে খুশি হয়ে বলিউডের গান গাওয়া শুরু করে দিয়েছিলাম। আর তখন মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে শুধুমাত্র আমরা আছি আর কেউ নেই।
ডাইনকুন্ড থেকে জট উপত্যাকা পর্যন্ত পৌঁছানোর মধ্যে পিয়াল পাঞ্জাল রেঞ্জ, চওয়ারি জট ইত্যাদির অপরূপ দৃশ্য দেখতে পেয়েছি। এই জায়গাটি এত পবিত্র ছিল যে আমার মনে অদ্ভুত এক শক্তির সঞ্চার করে। আর এরপর থেকে আমি বুঝতে পারি কেন আমার জীবনে ভ্রমণের প্রয়োজন। আমরা যতই জীবনে একা হয়ে থাকি ভ্রমণ কিন্তু আমাদের জীবনের এক অনবদ্য শক্তি হয়ে দাঁড়ায়।
এসবের বাইরে ও আমরা এখানে সুইজারল্যান্ড খাজ্জিয়ার এক অদ্ভুত ঘাস দেখতে পাই। তবে ডাইনকুন্ড গিয়ে আমি বুঝতে পারি যে সত্যি করে শান্ত পরিবেশে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার মতো আনন্দ আর কিছু হতে পারে না।
আপনি কী কখনও এমন জায়গা প্রয়োজন অনুভব করেছেন? আমি নিশ্চিত যে আমরা সবাই কোনো না কোনো সময়ে সবকিছু ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাই। আর সেই পালিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ হল আমাদের সুখকর স্মৃতি এবং দিবাস্বপ্ন।