প্রত্যেক শহরের পরিচিতি থাকে তার নিজস্ব কুইজিন এবং খাদ্যাভ্যাসে। কলকাতা, শহর হিসেবে সত্যিই যেন মহামানবের মিলনস্থল, কত জাতি, কত ধর্ম, কত ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ইচ্ছে, রুচি, অভ্যাস নিয়ে গড়ে উঠেছে তিলোত্তমার মানবসম্পদ। হয়তো তাই কলকাতার খাবারেও রয়েছে যেন একটা স্পেশাল টাচ, যে স্বাদের সত্যিই যেন কোনো ভাগ হবে না। আজকে পাঠকদের জন্যে তুলে ধরছি এমন কিছু খাবারের কথা যার সেরা টেস্ট পাওয়া যাবে কলকাতাতেই। শুধু স্বাদ নয়, ইতিহাস, আবেগ এবং ভালোবাসার মিশেলে এই খাবার গুলি যেন এক হয়েছে কলকাতার পরিচিতির সাথে।
নাহুমসের কেক - কলকাতার ইহুদি ঐতিহ্য
নিউ মার্কেটের ভিতরে নাহুমস কেকের দোকানের সূচনা হয়েছিল ১৯০২ সালে, নাহুম ইজরায়েল মোরদেকাই নামক বাগদাদের এক ইহুদি ব্যবসায়ীর উদ্যোগে। কলকাতার ইহুদি, আর্মেনিয়, পার্সি জনগোষ্ঠীর কাছে এই দোকানটি ছিল এক কালে খুবই প্রিয়। এখনও এখানে পাওয়া যায় বিশ্বমানের কেক, পেস্ট্রি, প্যাটি বা বিস্কুট। এরকম ঐতিহ্যশালী এবং ঐতিহাসিক দোকান থেকে বহু যুগের রেসিপি মেনে আসা দোকানের জিনিস খেতে চাইলে আসতেই হবে নিউ মার্কেটের নাহুমসের শোকেসের সামনে।
কিমার দই বড়া - ঠাকুরবাড়ির স্ট্রিট ফুড
দই বড়ার টেস্ট তো আমরা সবাই জানি। জানি কিমার তরকারীর খুঁটিনাটিও। কিন্তু দই বড়ার মতো এক আপাত উত্তর ভারতীয় রেসিপিকে আপন করে নিয়ে তাতে কিমার বড়া দিয়ে রান্না করার মতন অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির রাঁধুনিরা। কথিত আছে এই ডিশটি ছিল রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত প্রিয়। দল পূর্ণিমার সময়ে মটন কিমার দই বড়া খাওয়া ছিল ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্যের এক বড় অংশ। জোড়াসাঁকো এবং ধর্মতলা চত্বরের কিছু স্ট্রিট ফুডের দোকানে এখনো পাওয়া যায় এই ডিশটি।
কলকাতা চাইনিজ - দুই চায়নাটাউনের গল্প
পৃথিবীর হাতে গোনা কিছু শহরে রয়েছে দুটি করে চায়না টাউন। কলকাতা তাদের মধ্যে অন্যতম। টেরিটি বাজার এবং বাইপাসের ধরে ট্যাংরায় বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে দুটি চায়নাটাউন। কিন্তু দুই চায়নাটাউনের চাইনিজ কুকেদের উদ্যোগেই সম্ভব হয়েছে কলকাতা-চাইনিজ ঘরানার খাবারের সৃষ্টি। বাঙালী খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চাইনিজ উপকরণ এবং রেসিপি ব্যবহার করে তৈরি ডিশগুলির অন্যন্য স্বাদ কলকাতা থেকে শুরু হয়ে বর্তমানে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানান প্রান্তে। টেরিটি বাজারের ব্রেকফাস্ট হোক, বা ট্যাংরার কালজয়ী রেস্টুরেন্টে কাটানো সন্ধ্যা, এই স্বাদের সন্ধান পাবেন একমাত্র কলকাতায়।
চপ কাটলেট কবিরাজি - ব্রিটিশ কলোনিয়াল কুইজিন
উত্তর কলকাতার অলিতে গলিতে আজও পাওয়া যায় চপের দোকান, যেখানে আলুর চাপ, কাশ্মীরি চপের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে কাশ্মীরি চপ বা ক্যাপসিকমের চপ। আর রয়েছে ঐতিহাসিক কেবিনগুলি, যেখানে পাবেন কাটলেট, কবিরাজী, ডেভিলের মতন ডিশ। ৮০ বা ১০০ বছর পিছনে গেলেই কিনটি আমরা দেখতে পারবো কীভাবে এই ডিশগুলির পিছনে রয়েছে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব। ২০০ বছর ব্রিটিশ শাসনের ফাঁকে ফাঁকে গড়ে উঠেছে বাঙালী ও ব্রিটিশ খাদ্যাভ্যাসের ফিউশন, যা দেখতে পাই চপ কাটলেটের মতো খাবারে, যাদের উৎপত্তি হয়তো ব্রিটিশ চিন্তাধারায়, কিন্তু যাদের অন্তরে রয়েছে বাঙালিয়ানার পূর্ণ ছোঁয়া।
ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ স্ট্রিট ফুড - কলকাতা
ঝালমুড়ি, ঘুগনী, ফুচকা, চুরমুর, রোল, মোগলাই - স্ট্রিট ফুডের দিক থেকে কিন্তু কলকাতার কোনো বিকল্প নেই। বেস্ট স্ট্রিটফুডের পুরস্কারও তাই পেয়েছে শহর কলকাতা। প্রিন্সেপ ঘাট, ময়দান, ভিকটোরিয়া, রবীন্দ্র সরোবর, কলকাতা শহরের এই জায়গাগুলির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে অসাধারণ স্ট্রীট ফুডের সম্ভার। দেশের শ্রেষ্ঠ স্ট্রিটফুডের টেস্ট পেতে গেলে তাই আসতেই হবে কলকাতায়।
ফিউশন মিষ্টি - বাঙালিয়ানা আর আধুনিকতার মেলবন্ধন
বাঙালী মানেই মিষ্টিমুখ। আর কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের মিষ্টির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব জুড়ে। কিন্তু বাঙালীরা এখানেই থেমে নেই, আদি ও অকৃত্রিম মিষ্টিকে সঙ্গী রেখে এগিয়ে চলেছি নানান রকম এক্সপেরিমেন্টাল এবং ফিউশন মিষ্টি তৈরির পথে। আমাদের রসগোল্লা আজ স্থান পেয়েছে বেকড রসগোল্লার রূপে। চকোলেট , বাটারস্কচ বা স্ট্রবেরির ফ্লেভার মিশে গেছে সন্দেশের পরতে পরতে। মিষ্টি নিয়ে এমন সাহসী উদ্যোগ আর এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে শুধুমাত্র কলকাতাতেই। তাই এই নতুন যুগের মিষ্টি চেখে দেখতে হলে আসতেই হবে কলকাতার বুকে।