কেদারনাথ....যেখানে শুরু স্বর্গের রাস্তা
কেদারনাথ মন্দির ভারতের অন্যতম বিখ্যাত তীর্থস্থান। এটি শিবের বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের একটি। এটি তিনটি বিশাল পর্বত দ্বারা বেষ্টিত এবং মন্দাকানি নদীর তীরে অবস্থিত। কেদারনাথ মন্দিরে শিব আরাধ্য দেবতা
কেদারনাথ হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত, এবং সুন্দর পর্বত, উপত্যকা এবং নদী দ্বারা বেষ্টিত। শহরটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত এবং এটি ট্রেকার এবং অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
সেই ছোট্ট বেলাথেকেই আমার বড় জ্যেঠুর কাছে অনেক গল্পশুনেছি কেদারনাথ এর। চারিদিকে বড় ,বড় আকাশ ছোঁয়া পাহাড় আর যাত্রাপথে মন্দাকিনী সবসময়ের সাথী হয়ে থাকবে। সেই ইচ্ছে ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সাথে আরো বেশি হয়ে উঠেছিল। কলেজ, ইউনিভার্সিটি জীবনের ঠিক পরে বন্ধু দের সাথে বাবা তারকনাথের মাথায় জল ঢালতে যেতাম, তখন থেকেই সেই সুপ্ত ইচ্ছে গুলো পূরনের সুযোগ আসতেই একবার ও ভাবতেসময় নিইনি। অবশেষে সেই দিনটি তথা ২৪ শে মে ২০২২ দুন এক্সপ্রেস ধরে আমার আটজন কলিগ মিলে পৌঁছে গেলাম হরিদ্বার এ। সেখান থেকে সোজা একটি গাড়ি ভাড়া করে শোনপ্রয়াগ। আমাদের শোনপ্রয়াগে রাত্রিযাপনের ভাবনা থাকলে ও পরবর্তীতে গৌরিকুন্ডে রাত্রিযাপন করি। খুব ভোরে স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম কেদারের উদ্দেশ্যে।এই গৌরিকুন্ড ই হলো কেদারনাথ এর সিংহদ্বার।এখান থেকে হাঁটা পথে প্রায় ষোল কিমি (মাইলস্টোন এর হিসেবে) কিন্তু আমার মনে হয় রাস্তা প্রায় ২২-২৩ কিমি হতে পারে। নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একটি ব্যাগে ভরে, অন্যান্য ব্যাগপত্র হোটেলের ক্লক রুমে রেখে আমার সহযাত্রী দের নিয়ে এগিয়ে চললাম। রাস্তায় কিছুটা অন্তর বিভিন্ন চায়ের দোকান, ঠান্ডা পানিয় প্রায় সমস্ত রাস্তায় পেয়ে যাবেন, তাই এক বোতল জল ছাড়া অন্যান্য খাদ্য সামগ্রিক নেওয়ার প্রয়োজন নেই। সত্যিই কেদারের পথে মনমুগ্ধকর, উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় সাদা বরফে ঢাকা, মনে হয় কেউ যেন সাদা চাদর পরিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝে সুন্দরী চপলা, চঞ্চলা ছোট্ট ঝর্না গুলো মনকে আলোড়িত করে স্বপ্নের জগতে নিয়ে চলে যায়,আর সাদা মেঘেরা নব্য প্রেমের লুকোচুরি খেলছে। ওহ্ এককথায় অসাধারণ অনুভূতি, কতো তে পাহাড়ি ফুল ফুটে আছে। আমরা ধীরে ধীরে ছোট্ট ছোট্ট স্টেপে এগিয়ে চলছি, কয়েক জন কলিগের শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল,তাই একটু জিরিয়ে আবার এগিয়ে চললাম।প্রায় তিন কিলোমিটার যাওয়ার পর আমাদের একসহযাত্রীর সমস্যা বেড়ে যায়, তাই একটি খচ্চর ভাড়া করে ও এগিয়ে যায়। বাবা যখন ডেকেছেন পৌঁছাতে তো হবেই। শরীরের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা থাকলে ও বাবার দর্শন ই আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল।
এক এক করে জঙ্গলচটি,ভিমবলী ক্রশকরে এগিয়ে চললাম।এর মধ্যে আমার সহযাত্রী দের বেশ কয়েক জন পিছিয়ে পড়েছিল। সারা রাস্তা তে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই বললেই চলে, তাই কারো খোঁজ ও পাচ্ছিলাম না।প্রায় সারা রাস্তা জুড়ে মন্দাকিনীর কুল,কুল শব্দ মনকে এক ছন্দ দিয়ে ফেলেছিল। সেই ছন্দই কেদারনাথ ট্রেক কে করে তুলেছিল ছন্দ ও বৈচিত্র্যময়। যার সাথে কোন ট্রেকের তুলনায় চলে না। মনে মনে এতদিন কেদারনাথ এর কল্পনা, বাস্তবের সাথে মিলে মিশে একাকার হতে লাগলো। বেশ কয়েকটি নাম না জানা ঝর্না বয়ে চলেছে। ভীম বলিতে ২০১৩ এরপর যে নতুন সেতু বানানো হয়েছে, সেখান থেকেই শুরু হয়েছে বুকফাটা চড়াই। আরেক টি কথা প্রয়াত অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত ও সারা আলি খান অভিনীত কেদারনাথ ছবির দৌলতে দেবভুমি উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথ কে এক অন্যমাত্রা দিয়েছে এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। যাইহোক এগিয়ে চলেছি বেশ চড়াই ভেঙে, এখন মন্দাকিনী কে বামদিকে রেখে ছোট লিনচোলি অতিক্রম করার পর একটু হালকা টিফিন করেনিলাম, এতে নিজেকে বেশ সতেজ মনে হলো।
এরমধ্যে বেশ কিছু শর্টকাট রাস্তা ব্যবহার করেছি, একটু কষ্ট হলেও আমার মনে হয়েছে পুরো রাস্তায় ২ কিমি কম অতিক্রম করেছি। তবে পায়ের সমস্যা থাকলে শর্টকাট ব্যবহার করবেন না। অবশেষে বেসক্যাম্পের কাছে পৌঁছে গেলাম,এর মধ্যে আমার সহযাত্রী রাকেশ কিছু টা পিছিয়ে পড়েছিল। ঠিক মত নেটওয়ার্ক কাজ করছিল না।তাই ওরসাথে যোগাযোগ করার বৃথা প্রয়াস করে এগিয়ে চললাম।বেস ক্যাম্প অতিক্রম করতে ই কেদারনাথের মন্দির দেখতে পেলাম,দেখে এতক্ষনের যাবতীয় ক্লান্তি মুছে গেল। যাইহোক আর কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রায় সাড়ে তিন টের দিকে পৌঁছে গেলাম। ততক্ষণে আমার কয়েকজন সহযাত্রী খচ্চরে চড়ে পৌঁছে গিয়েছিল এবং একটি রাত্রিবাস এর রুমের ব্যবস্থা করেছিল। তবে মন্দিরে পৌঁছানোর পূর্বেই মন্দিরের দ্বার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম পাঁচটা নাগাদ আবার দর্শন শুরু হবে। হোটেলের রুমে গিয়ে ব্যাগ পত্র রেখে একটু ফ্রেশ হলাম। পাঁচটার দিকে মন্দিরে এসে বাবাকে দর্শন করলাম ও পুজো দিলাম। ততক্ষণে এক এক করে আমার পেছনের সহযাত্রীরা ও পৌঁছেছে।সন্ধ্যাবেলায় একটু মন্দির প্রাঙ্গণে ঘুরে হোটেলে ফিরলাম। খুব তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ফ্রেশ হয়ে মন্দির এ গিয়ে দেখি কয়েক হাজার দর্শনার্থী লাইনে দাঁড়িয়ে। অপেক্ষা করছিলাম সেই রঙিন বৈচিত্র্য দেখার জন্য। এমন সময় সূর্যদেব তার কিরনে বরফ শৃঙ্গের চূড়াগুলো সোনালী স্পর্শে ভরিয়ে দিল। নিমিষেই ফ্রেম বন্দীকরে নিলাম,এই রঙিন পরিবর্তন সারা জীবন মনের মনিকোঠায় অবস্থান করবে যা জীবনে কখনো ভোলা সম্ভব নয়। একটু মন্দির প্রাঙ্গণে ঘোরাঘুরি করে প্রাতরাশ সেরে ফেরার প্রস্তুতি নিলাম। কেদারনাথ এর সেই স্বর্গীয়টান কাটিয়ে আসতে ইচ্ছে না করলে ও,সব মায়া কাটিয়ে নিচে নামা শুরু করলাম।প্রায় দুটোর দিকে গৌরীকুন্ডে পৌছালাম।