উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় অবস্থিত স্থানীয় আলপাইন ফুলের তৃণভূমির জন্য বিখ্যাত ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স, যা নন্দাদেবী বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ-এর একটি অংশ। এটি ভারতবর্ষের বৃহত্তম বোটানিকাল গার্ডেন এবং ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই উপত্যকায় পৌঁছানোর সময় গন্তব্য পথে আপনার সাথে বিভিন্ন জনপদ, বিস্তীর্ণ বনভূমি, প্রাণী এবং বিভিন্ন রকমের উদ্ভিদের সঙ্গে পরিচয় ঘটবে, যা আপনার সারা জীবনের এক অমূল্য অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। উপত্যকাটি প্রায় ৬০০ রকম প্রজাতির ফুল দ্বারা সুসজ্জিত এবং এছাড়াও এশিয়াটিক কালো ভাল্লুক, তুষার চিতা, লাল শিয়াল এবং হিমালয়ের বার্ডস দেখতে পাওয়া যায়।
তাহলে নিম্নে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স পৌঁছানোর যাবতীয় তথ্য যেমন যাতায়াত, থাকবার জায়গা এবং বিভিন্ন রকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হল।
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস ন্যাশনাল পার্ক
পথ নির্দেশনা
• সূচনা পর্ব- দিল্লি থেকে হরিদ্বার হৃষীকেশ সারারাতের যাত্রা।
• প্রথম দিন- হরিদ্বার/ঋষিকেশ - যোশীমঠ।
• দ্বিতীয় দিন- যোশীমঠ - গোবিন্দঘাট - পুলনা - ঘাঙ্গারিয়া।
• তৃতীয় দিন- ঘাঙ্গারিয়া - ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স - ঘাঙ্গারিয়া।
• চতুর্থ দিন- ঘাঙ্গারিয়া - হেমকুণ্ড শাহিব - ঘাঙ্গারিয়া।
• পঞ্চম দিন- ঘাঙ্গারিয়া - গোবিন্দঘাট - যোশীমঠ।
• ষষ্ঠ দিন(ঐচ্ছিক)- যোশীমঠ - আউলী - গরসন বুগয়াল।
• সপ্তম দিন- যোশীমঠ - হরিদ্বার/ঋষিকেশ। এরপর সারারাত যাত্রা করে পুনঃরায় দিল্লি পৌঁছানো।
কীভাবে পৌঁছবেন
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স যেহেতু বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত তাই সেখানে যাওয়ার জন্য একাধিক পথ হয়েছে।
• ধরুন আপনি দিল্লি থেকে যাত্রা শুরু করলে প্রথমেই ঋষিকেশ/হরিদ্বারের জন্য বাসে যেতে হবে। আইএসবিটি কাশ্মীরি গেট বাক মঞ্জু কা টিলা থেকে প্রচুর বাস পেয়ে যাবেন।
• খরচ পড়বে মোটামুটি ৫০০ টাকা। এছাড়াও আপনি রাতের ট্রেনে সফর করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সকাল ৭টার আগেই হরিদ্বার/হৃষীকেশ পৌঁছাতে হবে। কারণ সেখান থেকে সর্বশেষ বাস ছাড়া হয় সকাল সাড়ে সাতটায়।
• হরিদ্বার/ঋষিকেশ থেকে আপনাকে অন্য একটি বাস করে প্রথমে যোশীমঠ আর যেতে হবে, যার দূরত্ব ২৮০ কিলোমিটার অতিক্রম করতে সময় নেবে ১০-১২ ঘণ্টা। যোশীমঠ যাওয়ার বাসের টিকিটের দাম ৪৮০ টাকা। অন্যদিকে আপনি চাইলে যোশীমঠ বা গোবিন্দঘাট থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে যেতে পারেন, যার জন্য খরচ পরবে প্রায় ৯০০০টাকা। যদিও যাত্রাপথের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনাকে সবকিছু ভুলিয়ে দেবে।
• যোশীমঠ থেকে গোবিন্দ ঘাট পর্যন্ত আপনাকে কারওর সাথে ভাগে বা ব্যক্তিগতভাবে ট্যাক্সি ভাড়া করতে হবে। কারোর সাথে ভাগে নিলে ট্যাক্সির মূল্য হবে জনপ্রতি ১০০ টাকা আর নিজস্ব ভাড়া করলে ১০০০ টাকা। এই ট্যাক্সিগুলি প্রায় একঘণ্টায় আপনাকে ২০ কিলোমিটার পথ পৌঁছে দেবে।
• গোবিন্দঘাট থেকে পুলনা পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার হাঁটাপথ পেরিয়ে আপনি ঘাঙ্গারিয়া বেস গ্রামের ট্রেকিং পথের সূচনা করতে পারবেন। পুলনা থেকে আপনি কারওর সাথে ভাগ করে ট্যাক্সি ভাড়া করতে পারেন, যার খরচ পড়বে জনপ্রতি ৫০ টাকা।
• ঘাঙ্গারিয়া থেকে আপনার ১৩ কিলোমিটারের একটি লম্বা ট্রেক শুরু হবে, যা শেষ করতে সময় লাগে প্রায় ৪-৬ ঘণ্টা।মনোরম পরিবেশে মসৃণ পথ দিয়ে ট্রেকিং করতে করতে সবশেষে ভউন্দার গ্রাম থেকে শুধু মাত্র পাঁচ কিলোমিটার খাড়া পথে প্রবেশ করবেন, যা শেষ হবে একেবারে ঘাঘরিয়া গিয়ে। পুলনা থেকে আপনি চাইলে কুলি বা খচ্চরও ভাড়া করতে পারেন। গোবিন্দঘাট থেকে ঘাঙ্গারিয়া পর্যন্ত হেলিকপ্টার পরিচয় পাওয়া যায়।
• উদ্দিষ্ট যাত্রাপথে আপনি অনেক ভোজনশালা রয়েছে যেখানে আপনি নিশ্চিন্তে আপনার খাবার খেয়ে নিতে পারবেন। এছাড়াও বেশ কিছু জায়গায় জলের দোকান খুঁজে পাবেন। এই দোকানগুলি থেকে আপনি আপনার জলের বোতলগুলিতে জল ভরে নিয়ে পুনরায় আবার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারবেন। তবে জ্ঞাতার্থে জানানো প্যাকেটের মধ্যে ভরা জল কিনে খাবেন না।
• ঘাঙ্গারিয়া ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স এবং হেমকুণ্ড শাহিব ট্রেক উভয়ের সূচনা পথ।
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ট্রেক
ঘাঙ্গারিয়া থেকে পরবর্তী উপত্যকার পাঁচ কিলোমিটার যাত্রা খুব তাড়াতাড়ি শুরু করতে হবে। কারণ উপত্যকাটি প্রায় আট কিলোমিটার প্রশস্ত। তবে এই উপত্যকার ঠিক কতটা দূরত্ব সম্পূর্ণটাই আপনার নিজের উপর নির্ভর করছে। কারণ এই উপত্যকায় ট্রেক করা কিন্তু খুব একটা কঠিন নয়। ট্রেকিং-এর পথ ক্রমান্বয়ে উপরে উঠে যেতে থাকে। আর তাড়াতাড়ি এই ট্রেকিং শুরু করার কারণ হল বিকেল পাঁচটার পর আপনি উপত্যকায় ভেতরে আর থাকতে পারবেন না। তবে সবকিছুর মধ্যে আপনি নিজের সাথে আপনার মধ্যাহ্নভোজন নিতে একবারে ভুলবেন না। কারণ এই উপত্যকাটি অন্বেষণ করতে করতে সারাদিন কেটে যাবে। আর এই উপত্যকায় ভেতরে কোন দোকান বা খাবার রেস্তোরাঁ নেই।
ঘাঙ্গারিয়া থেকে যাত্রা শুরুর ৩০ মিনিট পর আপনি একটি ফরেস্ট চেক পোষ্টে পৌঁছাবেন। সেখানে আপনার পরিচয় পত্র দেখাতে হবে এবং অনুমতি পত্র সংগ্রহ করতে হবে।আশিকের জন্য এই অনুমতি পত্রের দাম ১৫০ টাকা এবং বিদেশীদের জন্য ৬০০ টাকা, যা পরবর্তী তিন দিনের জন্য বৈধ থাকে। তবেই আপনি দুপুর ২টোর পর এই উপত্যকায় প্রবেশ করতে পারবেন না আর বিকেল ৫টার আগে চেক পোস্টে এসে আপনাকে রিপোর্ট করতে হবে, না হলে আপনার জরিমানা হবে। এছাড়াও উপত্যকায় প্রবেশের পূর্বে যদি আপনার কাছে কোনওরকম তামাকজাত দ্রব্য, অ্যালকোহল, স্পিকার, ড্রোন ইত্যাদি থাকে তাহলে সেগুলি চেক পোষ্টে জমা করতে হবে। ঘোরা শেষ হলে পুনরায় সেগুলো ফিরিয়ে নিতে পারবেন।
এবার চলে এসেছে সেই সময়। যখন আপনি মূল উপত্যকায় প্রবেশ করে রঙীন আলপাইন ফুলের তৃণভূমি দেখে চমকে উঠবেন। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য ফুল হল ব্লু পপি, ডগ ফ্লাওয়ার, মেরিগোল্ড, হিমালায়ান রোজ, অর্কিড, হিমালয়ান বেল ফ্লাওয়ার ইত্যাদি। তবে যদি আবহাওয়া পরিষ্কার থাকে তবে নীলগিরি পর্বত, ভউন্দার খাল, গৌরী পর্বত ইত্যাদি পর্বতশৃঙ্গগুলি দেখতে পাবেন।
হেমকুণ্ড সাহিব ট্রেক
শিখ মাজারগুলির মধ্যে অন্যতম হল এই হেমকুন্ড সাহিব। ১৫২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই হেমকুন্ড সাহিব বিশ্বের সর্বোচ্চ গুরুদ্বার হিসেবে স্বীকৃত। যাত্রাপথ মোটামুটি খাড়া হলেও প্রশস্ত। তাই ৬ কিলোমিটার পথ মাত্র ৪/৫ ঘন্টায় পৌঁছানো যায়। আপনি যদি একান্ত ট্রেক করতে না চান তবে ঘাঙ্গারিয়া থেকে কুলি বা খচ্চর ভাড়া করতে পারেন। যাত্রাপথে বেশ কয়েকটি দোকান ধাবা এবং জলের দোকানে রয়েছে।
হেমকুণ্ড হিমবাহ লেকের আয়নার মতো স্বচ্ছ জলের পাশে জাদুকরী গুরুদ্বার অবস্থিত। এই হ্রদটি হাতি পর্বত এবং সপ্তঋষি পর্বতশৃঙ্গ থেকে বয়ে আসা হিমবাহ দ্বারা পুষ্ট। আবু পরিষ্কার থাকলে আপনি গুরুদ্বার এবং পাহাড়ের মাঝখানে প্রতিফলন লক্ষ্য করতে পারবেন। হেমকুণ্ড সাহিবে পেয়ে যাবেন বিরল প্রজাতির ব্রহ্মকমলের খোঁজ। ক্লান্তিকর ট্রেকটির শেষে ১৫০০০ ফুট উচ্চতায় গরমের ল্যাঙ্গারের স্বাদ উপভোগ করতে একদমই ভুলবেন না, যা আপনারা জীবন মনে থাকবে। সাধারণত সবাই সন্ধ্যাবেলা ঘাঙ্গারিয়া থেকে ফিরে আসেন। তবে আপনি চাইলে এক রাতের জন্য গুরুদ্বারে থাকতে পারেন।
এইবার এই ট্রেকটি সম্বন্ধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করব। যার মধ্যে প্রথম হল আপনি চাইলে খুব তাড়াতাড়ি এই উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারবেন। ১০০০০ ফুটের (ঘাঙ্গারিয়া) মধ্যে ৫০০০ ফুট মাত্র ৪/৫ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন। অতএব বুঝতেই পারছেন যাদের অ্যাকিউট মাউন্টেন সিকনেস(এএমএস) রয়েছে তাদের অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই এই রোগ প্রতিরোধ করতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম এবং ভালো খাবার এবং নিজেকে হাইড্রেটেড রাখতে চেষ্টা করুন। এএমএস-এর সাধারণ কিছু লক্ষণ হল বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা, ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট ও ক্ষিদে হ্রাস পাওয়া।
ঘুরতে যাওয়ার সঠিক সময়-
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স বছরের বেশিরভাগ সময় বরফে ঢাকা থাকে। তাই সাধারণত জুন মাসে একটি খোলা হয় এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এখানে ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি পত্র দেওয়া হয়। তবে নির্দিষ্ট করে এর খোলা বা বন্ধের সময় বা তারিখ নেই। সেটি তুষারপাতের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে। প্রতিবছর আলপাইন ঘাসের মধ্য দর্শনীয় ফুল বোনানজাr দেখা মেলে।
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-এ ঘোড়া সবথেকে আদর্শ সময় হল জুলাই মাসে মাঝখান থেকে আগস্ট মাসের মধ্যবর্তী সময়। কারণ এই সময়ে বছরের সব বেশিরভাগ রঙিন ফুল ফুটে উপত্যকাটিকে রাঙিয়ে তোলে। আগস্ট মাসের পর ধীরে ধীরে ফুলের সংখ্যা কমতে থাকে এবং বেশিরভাগ গাছ মারা যেতে শুরু করে। এর সাথেই রেখে যায় পরবর্তী বছরের জন্য মূল্যবান বীজ।
কোথায় থাকবেন
যোশীমঠ- প্রাথমিকভাবে যোশীমঠ খুব উন্নত এবং বৃহৎ একটি শহর, যেখানে থাকার জন্য অনেক রকমের জায়গা খুঁজে পাবেন। দামি রিসোর্ট থেকে শুরু করে হোটেল, গেস্ট হাউস, ধর্মশালা আশ্রম সবকিছু এখানে পেয়ে যাবেন তাও আবার মাত্র ৫০০ টাকার মধ্যে।
ঘাঙ্গারিয়া- ঘাঙ্গারিয়া গ্রামটি মূলত হোটেল এবং গেস্ট হাউসের জন্য বিখ্যাত। আপনি চাইলে ঘাঙ্গারিয়া হেলিপ্যাড- এর পাশে জিএমভিএন গেস্ট হাউসে থাকতে পারেন। এখানে মোটামুটি ৫০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত সবরকমের ঘর রয়েছে। আর আপনি যদি আরেকটু সস্তায় থাকতে চান তাহলে গুরুদ্বারে থাকতে পারেন। গুরুদ্বারে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে থাকবার সুবন্দোবস্ত রয়েছে।
মোবাইল এটিএম পেট্রোল পাম্প
ঋষিকেশ থেকে গোবিন্দঘাট পর্যন্ত মোবাইলের খুব সুন্দর পরিষেবা পেয়ে যাবেন। তবে ঘাঙ্গারিয়াতে জিও এবং বিএসএনএল একমাত্র কাজ করে। ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-এ কোনওরকম মোবাইল পরিষেবা নেই।
যোশীমঠে শেষ এটিএম কাউন্টার রয়েছে। আপনার যতটা খরচ করার ততটাই এখান থেকে আপনাকে সংগ্রহ করতে হবে।
শেষ পেট্রোল পাম্পটিও যোশীমঠে অবস্থিত।
বর্ষায় ট্রেকিংয়ের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
১. জল প্রতিরোধী ট্রেকিং প্যান্ট।
২. রেনকোট অথবা পঞ্চ।
৩. ব্যাগের জন্য জন্য রেইন কভার।
৪. ওয়াটারপ্রুফ ট্রেকিং জুতো।
৫. স্টুরডি ওয়াকিং স্টিক অথবা ট্রেকিং পোল।
৬. অতিরিক্ত এক জোড়া মোজা।
৭. উইন্ডোজ অথবা ওয়াটারপ্রুফ জ্যাকেট।
৮. পূজা কাপড়ের জন্য প্লাস্টিক ব্যাগ।
৯. ওয়াটারপ্রুফ গ্লাভস।
১০. ছাতা।
যদি আপনি অ্যাডভেঞ্চার খুঁজতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে পরেন, তাহলে এটাই ট্রেকিং-এর আদর্শ সময়।