২০২০ এর মার্চ মাসের একদম শুরু দিকে করোনা তখনও তার থাবা ভারতে বসায়নি সেই সময় ৩ দিনের একটা ছোট্ট ছুটিতে ঘুরে এসেছিলাম চিকমাগালুর। আর চিকমাগালুর থেকে ব্যাঙ্গালোর ফেরার পথে আমাদের স্টপেজ ছিল বেলুর, হ্যালেবিড আর শ্রবনবেলগোলা। এই রাস্তার প্রথমেই আসবে বেলুরের চেন্নাকেশব মন্দির। দ্রাবিড় মন্দির স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন হলো এই মন্দির। গোটা কর্ণাটক জুড়েই হৈসল সাম্রাজ্যে নির্মিত স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন মেলে। এই হৈসল সাম্রাজ্যের সময়েই দক্ষিণভারতের শিল্প স্থাপত্যের উৎকর্ষতা চরম শিখরে পৌঁছয়।
কর্ণাটকের হাসান জেলায় অবস্থিত এই মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয় হৈসল রাজবংশের রাজা বিষ্ণুবর্ধনের আমলে। ভগবান বিষ্ণুকে উৎসর্গ করে ১১১৭ খ্রিস্টাব্দে য়াগাচি (Yagachi) নদীর ধারে শুরু হয় এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ, আর সেটা সম্পূর্ণ হতে সময় লাগে ১০৩ বছর। কিন্তু চতুর্দশ শতাব্দীর একদম শুরু দিকে দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খলজির সেনাধক্ষ্য মালিককাফুর বেলুর আর হ্যালেবিড আক্রমণ করে এবং অনেক স্থাপত্যই নষ্ট করে দেয়। চেন্নাকেশব মন্দির তার কুদৃষ্টি থেকে রেহাই পায়নি। পরে যদিও বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সময়কালে এই মন্দির মেরামত করা হয়। সমস্ত মন্দির জুড়ে নক্সা, ভাস্কর্য, কারুকার্য নষ্ট হওয়ার পরেও যে নিদর্শন রয়েছে তা মনে বিস্ময় জাগায়। মন্দিরের দেওয়ালে কখনো ফুটে উঠেছে বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতার, কখনো বা রামায়ণ মহাভারতের ঘটনা।
৪৪৩ X ৩৯৬ ফুট জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই চেন্নাকেশব মন্দির। গোপুরম দিয়ে মন্দির চত্বরে প্রবেশ করার পরেই নজরে পড়বে গরুড স্তম্ভ। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সময়কালে এই স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। গরুড স্তম্ভের বাঁ দিকে কিছুটা ব্যবধানে আর একটা স্তম্ভ নজরে আসবে। সেটিকে দীপ স্তম্ভ বলা হয়। এই দীপ স্তম্ভ নির্মিত হয়েছিল হৈসল সাম্রাজ্যের সময়কালে। ৪২ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দীপ স্তম্ভের বিশেষত্ব হলো এটি কেবল একটি বৃহৎ গ্রণাইট পাথরের খণ্ডের উপরে দাঁড়িয়ে আছে, এর কোনো অংশই মাটির নিচে প্রোথিত নেই। আটশো বছরের অধিক কাল ধরে নিজ ওজনের সাহায্যে এই স্তম্ভ একই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভটির তলদেশের তিনটি বিন্দু পাথরের বেদির উপর স্পর্শ করে আছে। স্তম্ভটির তলদেশ ও গ্রণাইট পাথরের বেদির মধ্যে ফাঁক আছে কারণ স্তম্ভটির তলদেশটি একদিকে একটু উঠে আছে। স্তম্ভটির Centre of Gravity এমনই যে অত উঁচু নিরেট গ্রণাইট পাথরের বিপুল ওজন ঐ তিনটি বিন্দু দিয়ে ভূমিতে প্রেরিত হয়।
গোপুরম দিয়ে ঢুকে সোজা হাঁটলে যে বিরাট মন্দিরটি নজরে আসবে সেটিই মূল মন্দির যেটি কেশব মন্দির নামেও পরিচিত। ভগবান বিষ্ণুকে উৎসর্গ করেই এই মূল মন্দির। মূল মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে খোদাই করা কারুকার্যই সবথেকে বেশী নজর কাড়বে। এছাড়াও গোটা মন্দির চত্বর জুড়েই অনেক মন্দির রয়েছে। আর প্রতিটা মন্দিরের দেওয়ালেই খোদাই করা আছে পুরাণ গাথা। মন্দিরের ভেতরেও থামগুলোতে খোদাই করা নকশা দেখলে অভিভূত হতে হয়। এছাড়াও মন্দিরের ভেতরে ছাদেও রয়েছে কারুকার্য।
বেলুড় মন্দিরের ভাস্কর্যের চরমতম প্রকাশ হলো মদনিকা মূর্তি। কার্নিসের নীচে ছোট ছোট স্তম্ভের উপর সারা মন্দির জুড়ে মোট আটত্রিশটি মূর্তি রয়েছে। আর গর্ভমন্দিরের ভিতরে চারটি। এই মূর্তিগুলোর মধ্যে এমন এক শিল্প সুষমা সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে যা দর্শকদের বিস্ময়ে অভিভূত করে।
হৈসল যুগে নির্মিত প্রায় সব মন্দিরেই হৈসল রাজপ্রতীক দেখতে পাওয়া যায়। চেন্নাকেশব মন্দিরও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রতীকে দেখতে পাওয়া যায় এক ব্যক্তি একটি বাঘকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করছে। এটা নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা শুনতে পাওয়া যায়। কন্নড় লোককথা অনুযায়ী এই প্রতীকের সাথে সল নামে এক যুবকের কাহিনি পাওয়া যায়। লোককথা অনুযায়ী অঙ্গডির (বর্তমানে সোসেবুরু বা Sosevuru) বাসন্তিকা দেবীর মন্দিরে সল একটি বাঘকে আঘাত করে তার জৈন গুরু সুদত্তকে রক্ষা করেন। প্রাচীন কন্নড় ভাষায় (হ্যালেকন্নড় বা Halegannada) ‘আঘাত’ শব্দটির প্রতিশব্দ হল ‘হৈ’। তা থেকেই ‘হৈ-সল’ নামটির উৎপত্তি। এই কিংবদন্তিটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বিষ্ণুবর্ধনের বেলুরুতে খোদিত লিপিতে (১১১৭ খ্রিষ্টাব্দ)। তবে সলের এই কাহিনিটির মধ্যে অনেক অসংগতি থাকায় এটিকে নিছক একটি লোককথা বলেই ধরে নেওয়া হয়।আবার অনেকে মনে করেন টালাকাডুর যুদ্ধে রাজা বিষ্ণুবর্ধন চোলেদের পরাজিত করার পর এই প্রতিকটির উদ্ভব ঘটে। কারণ হৈসল রাজপ্রতীকে দেখা যায় এক কিংবদন্তি যোদ্ধা একটি বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। আর বাঘ ছিল চোলেদের রাজপ্রতীক। তাই সেখান থেকেই এই প্রতীক। প্রতীকের কারণ যাই হোক না কেন হৈসল যুগে এই প্রতীকের গুরুত্ব যে কতখানি ছিল সেটা ঐসময়কার মন্দির বা স্থাপত্য পরিদর্শন করলেই বোঝা যায়।
খুব ভালো করে মন্দির পরিদর্শন করতে গেলে হাতে কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা সময় অবশ্যই রাখতে হবে। তবে এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি একবার পর্যবেক্ষণ করা শুরু করলে সময় কোথা দিয়ে চলে যাবে বুঝতেই পারবেন না। তাই ব্যাঙ্গালোরে গেলে একটা দিন আপনারা বেলুরের জন্য রাখতে পারেন।
কীভাবে যাবেন ?
ব্যাঙ্গালোর থেকে বেলুর প্রায় ২২০ কিমি। তাই গাড়ি বুক করে যাওয়া সব থেকে ভাল। ক্যাবে মোটামুটি চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা লাগবে। কম খরচে পৌঁছাতে চাইলে আপনি ব্যাঙ্গালোর থেকে বাসেও পৌঁছতে পারেন। তবে বেলুর এলে অবশ্যই এর সাথে হ্যালেবিদ আর শ্রবনবেলাগোলাও প্ল্যানে রাখবেন। আমরা চিকমাগালুর ভ্রমণের সময়ই এই জায়গাগুলো ঘুরেছিলাম। তাই আপনাদের প্ল্যান যদি থাকে চিকমাগালুর তাহলে অবশ্যই এই জায়গাগুলো আপনাদের প্ল্যানে রাখুন।