ছোটবেলা থেকে ঠাম্মার মুখে একটা প্রবাদ শুনে আসি,পুরনো চাল ভাতে বাড়ে আর সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা যত পুরনো হয় তার মধুরতাও তত বেশি হয়ে ওঠে। শুধু সম্পর্ক বা খাবারের ক্ষেত্রে নয়, অনেকের পুরনো জিনিসের প্রতিও একটা আলাদা আকর্ষণ থাকে। অনেক বাড়িতে পুরনো আসবাবপত্র দিয়ে ঘরকে সাজিয়ে তুলতে দেখা যায়। ঠিক সেই রকমই রাস্তায় হঠাৎ ঘুরতে বেরিয়ে কোনো জায়গায় ভগ্নপ্রায় অংশ দেখে আমরা কখনও কখনও সেখানে ফটো তোলার জন্য আগ্রহ সহকারে এগিয়ে যায়। শুধু ছবি তুলতে নয়, সেই সমস্ত জায়গার ইতিহাস যখন জানতে পারি তখন সেই রোমাঞ্চকর গল্প শরীরের পেশীকে সংকোচিত করে তোলে।
আজ সেইরকমই পাঁচটি ঐতিহাসিক ভগ্নপ্রায় মন্দিরের কথা আলোচনা করব, যেগুলির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু চাপা পরে যাওয়া ইতিহাস। শুধু তাই নয়, মন্দিরের কারুকার্য আজও বহু মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
পুরুলিয়া শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি জলমগ্ন প্রত্নস্থল। ১৯৫৭ সালে এখানে অনেক মন্দির স্থাপন করা হয়, যেগুলির বেশিরভাগ আজ প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটি জলমগ্ন অবস্থায় পরে রয়েছে। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের বাঁধ নির্মাণের জন্য স্থানটি জলমগ্ন হয়ে যায়। ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, একসময় এইস্থানে পাঞ্চেত ও কাশীপুরের রাজাদের প্রভাব ছিল। পূর্বে এই জায়গাটি বিহারের মানভূম জেলার অন্তর্গত ছিল।
বর্ধমান জেলার তেজগঞ্জ অঞ্চলের প্রবেশ করলেই দেখা যাবে বিভিন্ন রকম জংলি গাছপালা দিয়ে ঢাকা, কঞ্চির বেড়া দিয়ে কোন রকমের সেরা একটি ভগ্ন মন্দির, যেটি সতী মন্দির নামে জনপ্রিয়। এখানে একটি বহু পুরনো বটগাছ রয়েছে। মন্দিরের স্বাধীনতা ঘোষণা হলেও কালীপুজোর সময় এখানে বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে দেখা যায়। স্থানীয়দের কাছ থেকে শোনা যায়, সতীদাহ প্রথার প্রেক্ষাপটের সঙ্গে এই মন্দিরের অনেক ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক যখন সতীদাহ প্রথা রদ করেন তখন এই সতী মন্দিরগুলি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। আর তারপর থেকে এই মন্দিরটি প্রায় ভগ্নদশায় রূপান্তরিত হয়েছে।
পূর্বে কিরীটকণা নামে পরিচিত এই মন্দিরটি ভাগীরথী নদীর পশ্চিম পাড়ে ডাহাপাড়া থেকে দু'কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি একটি সতীপীঠ হিসেবে ধরা হয়। সতীর মাথার প্রশ্ন ক্ষতিতে জাজ্বল্যমান কিরীট-টি এখানে পতিত হয় বলে জানা যায়। গর্ভগৃহে প্রতিষ্টিত দেবীর নাম কিরীটেশ্বরী। তবে বর্তমানে গর্ভগৃহ শুন্য। রয়েছে একটি উঁচু বেদীর উপর আরেকটি খণ্ড অর্ধপদ্মাকৃতি প্রস্তরখণ্ড, যেটি সতীর পাদপীঠ।
দেউলঘাটা পুরুলিয়া থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে আড়ষা থানার অন্তর্গত এটি একটি প্রত্নস্থল। এক সময় এই জায়গায় অসংখ্য ইটের দেউল মন্দির ছিল। তবে বর্তমানে মাত্র দুটি দল মন্দিরের অস্তিত্ব রয়েছে। বাকি কিছু কিছু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। এখানে প্রস্তরনির্মিত বহু মূর্তি রয়েছে। যে গুলির মধ্যে বর্তমানে দুর্গামূর্তি, চতুর্ভূজা দেবীমূর্তি, সিংহবাহিনী দেবীমূর্তি, রণচণ্ডী, গণেশ মূর্তি, ভগ্ন ধ্যান মূর্তি, শিবলিঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়।
যমুনা নদীর বাঁধের তীরে অবস্থিত বাঁকুড়া জেলার বৃহত্তম পঞ্চরত্ন মন্দির। মন্দিরটি প্রধানত ল্যাটেরাইট পাথর দিয়ে নির্মিত। তাই মন্দিরের সারা গায়ে, খিলানগুলিতে ল্যাটেরাইট পাথরের উপর বিভিন্ন রকম কারুকার্য দেখতে পাওয়া যায়। মন্দিরের চূড়ায় ঘট বসানো রয়েছে। এই মন্দিরের সঙ্গে আরও তিনটি মন্দির অবস্থান করছে সেখানে নৃসিংহ অবতার, বামন অবতার এবং বরাহ অবতারের পাথরের বিগ্রহ রয়েছে। বর্তমানে এই মন্দির থেকে মুক্তি চুরি হয়ে গিয়েছে।
৬. রত্নমন্দির (বিষ্ণুপুর)-
এখানে মদনমোহন, রাধাগোবিন্দ, কালাচাঁদ, নন্দলাল, রাধামাধব মন্দিরগুলি জনপ্রিয়। ইট এবং ল্যাটেরাইট পাথর দিয়ে এই মন্দিরগুলি তৈরি হয়েছে। কালাচাঁদ মন্দিরের গায়ে আঁকা রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী। অষ্টকোণাকৃতির নবরত্ন নির্মিত এই মন্দিরের চূড়ায় রয়েছে পদ্ম, আমলক, ঘট ও ধ্বজা। এখানে নাটমন্দির দেখতে পাওয়া যায়। তবে এই মন্দিরগুলির এক অংশ প্রায় ভগ্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে।