আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে বিষ্ণুর অবতার রূপে জগন্নাথ দেবের পুজো হয়ে থাকে, যেটি আপামর হিন্দু বাঙালির কাছে রথযাত্রা নামে পরিচিত। ভারতবর্ষের মূলত পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যা রাজ্য রথযাত্রার জন্য বিখ্যাত পীঠস্থান। উড়িষ্যার রথ দেখতে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সামনে কোটি কোটি মানুষের জমায়েত নজরে পড়ে। শুধু দেশ নয় বিদেশ থেকেও অনেক মানুষ এই সময় পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে আসেন।
রথযাত্রা নিয়ম-আচার-
রথযাত্রার দিন বছরে প্রথমবার পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা-র মূর্তিকে মন্দির থেকে বের করে আনা হয়। যাত্রা শুরুর আগে রথের সামনের পথ সোনার ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। তারপর তিনটি রথকে পুষ্প দিয়ে সাজানো হয়। এরপরে তাশা, ঢাক, ঢোল, ভক্তদের প্রার্থনা, মন্ত্র-জপের মাধ্যমে এই যাত্রা শুরু হয়। সেই সময় জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার রথের দড়ি টানার জন্য লক্ষ লক্ষ ভক্ত তখন এগিয়ে আসেন।
পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে গুন্ডিচা মন্দিরের রথ টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। গুন্ডিচা মন্দির হল জগন্নাথদেবের পিসির বাড়ি। আর এখানে বিশ্বকর্মা জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার মূর্তি তৈরি করেছিলেন। পিসির বাড়ি যাওয়ার পরে সন্ধ্যায় ভোগ নিবেদন করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, মন্দির থেকে পিসির বাড়ি যাওয়ার যাত্রাপথে যে সমস্ত পূর্ণার্থী রথের দড়ি টানতে পারে, তারা জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তি পায়।
করোনার আবহে রথ যাত্রার বিধি-নিষেধ-
গতবছর-
• ২০২০ সালের ২২শে জুন প্রথমবার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা পালিত হয়েছে পুণ্যার্থীদের সমাগম ছাড়া।
• সরকারের সমস্ত বিধি নিষেধ মেনে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হলেও তার জাঁকজমকপূর্ণতা একেবারেই চোখে পরেনি।
• শুধুমাত্র মন্দিরের পূজারীরা এই রথ নিয়ে রাজপথ দিয়ে জগন্নাথের পিসির বাড়ি পৌঁছান।
• প্রত্যেকে সঠিক দূরত্ব মেনে এবং মাস্ক-স্যানিটাইজার সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
• রথ যাত্রার আগের দিন থেকে জগন্নাথ মন্দিরের সামনে পুলিশের ব্যবস্থা করা হয়।
• মন্দির থেকে রথ বেরোনোর পরে পুরোহিতের সাথে সাথে পুলিশরাও সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষা গণ্ডি তৈরি করে সেই রথ নিয়ে এগিয়ে যান।
• অগুনতি ভক্তদের জন্য সকাল থেকে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলোতে সরাসরি রথযাত্রা সম্প্রসারণ করা হয়।
এইবছর-
• ২০২১ সালের ১২ই জুলাই সোমবার রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।
• গত বছরের মত এ বছরও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার কারণে উড়িষ্যা সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রথ যাত্রার উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তিকে টিকা নিতে হবে এবং ২ দিন আগে আরটিপিসিআর পরীক্ষা করিয়ে ন্যূনতম সংখ্যায় সমাবেত হওয়া যাবে।
• মন্দিরের পূজারীরা সঙ্গে রথ নিয়ে প্রশাসন এবং পুলিশকর্মীরা এগিয়ে চলবেন।
• রাজপথে তিনটি রথের নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
• প্রতিটি রথের দড়ি টানার জন্য সর্বোচ্চ ৫০০ জন পর্যন্ত ভক্ত নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে এগোতে পারবেন।
• পুরী ছাড়া উড়িষ্যার অন্য কোথাও ছোট বড় রথ টানার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
• করোনার নিয়ে যে সব বিধি-নিষেধ রয়েছে সেগুলি সমস্ত মানা হবে বলে কমিটির তরফ থেকে জানানো হয়েছে।
রথযাত্রা হিন্দু ধর্মের অন্যতম একটি বড় উৎসব। এই উৎসবে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসেন শুধুমাত্র একবার জগন্নাথ দেবকে দর্শন করার আশায়। বিভিন্ন জায়গায় রথযাত্রা উপলক্ষ্যে বড় বড় মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মাটির পুতুল, জিলিপি, পাপড় ভাজা, বাদাম ভাজা সবকিছু রথযাত্রা এক অন্যতম প্রতীক।
বহু মানুষের সমাগমে গড়ে ওঠা মেলার দৃশ্য দু বছর আগেও বিভিন্ন জায়গায় ধরা পড়ত। কিন্তু আজ আর নেই। তাই বিদীর্ণ ভগ্নহৃদয় নিয়ে এই বছরও ভক্তরা টিভিতে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা দেখে নিজেদের মন ভরাবে। আর সেই সঙ্গে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবে,পরের বছর সমস্ত কালো মেঘ কাটিয়ে রথযাত্রা যেন তার নিজস্ব মহিমায় ফিরে আসে।