মনে পড়ে খুব ছোটবেলায় যখন সন্ধ্যার সময় পড়াশোনা করে উঠতাম তখন প্রায়ই বাড়িতে লোডশেডিং হয়ে যেত। বিশেষ করে গরমকালে বিদ্যুৎ না থাকলে খুব কষ্ট হত। কারণ তখন তো আর এত ইনভার্টার বা জেনারেটরের প্রচলন ছিল না। তাই সেই সময় আমার দাদু আমাকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করত। বৈদ্যুতিক চালিত পাখার থেকে হাতপাখার হাওয়া কিন্তু খুব মিষ্টি। তাই জীবনে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে আসার পরেও যখন কোন মেলায় যেতাম তখন সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের হাতপাখা কিনে আনতাম। কখনও সেগুলো কাজে লাগতো, আবার কখনও ঘরের কোণে পড়ে থাকত। তবু সেগুলি দেখলে ছোটবেলার স্মৃতিটা কিন্তু চোখের সামনে ভেসে উঠত। আর এইসব থেকেই আমার ক্রমশ হাতপাখা তৈরির ইতিহাস জানার আগ্রহ বাড়তে শুরু করল। বিভিন্ন জায়গা থেকে হাতপাখা তৈরির প্রক্রিয়া সম্বন্ধে নানা তথ্য সংগ্রহ করার পর, যা জানতে পারলাম, আজ সেগুলোই তোমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে এলাম।
হাতপাখা তৈরির ইতিহাস-
আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে গ্রিক-রোমানদের যুগে হাতপাখা প্রথম প্রচলন হয়। চিন ও জাপান থেকে ইউরোপীয় বণিকরা প্রথম হাতপাখা নিয়ে আসেন।সেই হাতপাখাগুলিতে মণিমুক্তো, সোনারুপো, হাতির দাঁত, বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক ঘটনা, ধর্মীয় কাহিনি, ফুল, ফল, পাখি, নানা নিয়মাবলী আঁকা থাকত। কারণ এইসব চিত্র দেখেই সাধারণ মানুষ বর্তমান সমাজ সম্বন্ধে কিছুটা ধারনা পেতেন। প্রথমদিকে পাখাগুলি একটি ভাঁজের হলেও পরবর্তীতে পাখা ভাঁজে ভাঁজে তৈরি হতে শুরু হয়। আঠারো শতকের প্রথম দিকে ইউরোপের হাত ধরে হাতপাখা তৈরির শুভসূচনা হলেও, চিনের পাখার বাজার কিন্তু রমরমিয়ে চলতে শুরু করে। পুরনো দিনের সেই পাখাগুলির বেশ কিছু নমুনা এখনও সংগ্রহশালায় রয়েছে। জানা যায়, হেলেন অফ ট্রয়, আইভরি পার্ল ফন্টেজ, ট্রাইফোল্ড-এর মতো প্রায় ৩৫০০ বেশি দুষ্প্রাপ্য পাখা লন্ডনের গ্রিনউইচ জাদুঘরের সংগ্রহশালায় দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলার হাতপাখা-
শুধু বিশ্বের দরবারে নয়, হাতপাখার প্রচলন কিন্তু গ্রাম বাংলায় সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়। অতীতকাল থেকে বর্তমানকালেও এই হাতপাখার ব্যবহার রয়ে গিয়েছে। গ্রাম বাংলার বেশ কিছু ঘরের আজও নিয়মিত হাতপাখার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। অতীতে রাজা-মহারাজাদের রাজপ্রাসাদে কিংবা আদালতে বিচারকের কক্ষে এই হাতপাখা ব্যবহার করা হত। ক্লান্ত পথিক, পরিশ্রান্ত শ্রমিক বাড়ি ফিরে হাতপাখার হাওয়া খেয়ে তার ঘর্মাক্ত শরীরকে একটু বিশ্রাম দিত। কিন্তু বর্তমানে পাখার ব্যবহার এতটা না হলেও, বেশ কিছু বিশেষ কাজে যেমন- ষষ্ঠী, ঠাকুর বরণ ইত্যাদি কাজগুলোতে পাখার সম্পূর্ণ ব্যবহার রয়েছে।
হাতপাখার ধরন-
১. তালপাতার পাখা-
গ্রাম বাংলার সবচেয়ে বেশি প্রচলিত এবং ব্যবহৃত পাখাটি হল তালপাতার হাতপাখা। শীতকালের মাঝামাঝি সময়ে এই পাখা তৈরি করা শুরু হয়। তবে এই পাখাতে শুধুমাত্র গরম দূর করার জন্য ব্যবহার করা হয় তা নয়, গ্রামবাংলায় হাতপাখা দিয়ে বিভিন্ন রকম আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। তালপাতার পাখা তৈরি করতে প্রথমে তাল গাছের কচি বড় বড় পাতা কাটা হয়। তারপর সেগুলিকে জলে ভাল করে ধুয়ে রোদে শুকানো হয়। পাতাগুলি শুকনোর সময় বাঁশ গাছ থেকে বাঁশ কেটে সেখান থেকে ছোট ছোট বাঁশের কঞ্চি বের করা হয়। তালপাতা শুকিয়ে গেলে সেগুলিকে সমান মাপ করে ছোট ছোট আকারে কেটে নিয়ে তারপর সেই বাঁশের কঞ্চির মধ্যে গেঁথে নানা রকম বুনন প্রক্রিয়া দ্বারা এই পাখা প্রস্তুত করা হয়। পাখাটি প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পরে তার উপরে লাল সবুজ রং দিয়ে কারুকার্য করা হয় এবং সবশেষে যে অংশগুলো অসম সেগুলোকে কেটে বাদ দিয়ে পাকাটির সমান এবং মসৃণ করে তোলা হয়। তালপাতার পাখা তৈরীর পুরো প্রক্রিয়াটি কিন্তু গ্রামের মানুষ নিজের হাতে করে থাকেন।
২. নকশী পাখা-
এই পাখা মূলত বাংলাদেশের লোকশিল্প হিসাবে স্বীকৃত। এটি তালপাতা ছাড়াও খেঁজুর পাতা, শোলা, বাঁশ, বেত, যবের কাঠি এবং ময়ূরের পালক দিয়ে তৈরি করা হয়। এইটা কাটি দেখতে চৌকো হয়। প্রথমে পাতা দিয়ে পাখাটিকে বুনে নেওয়া হয়। তারপর বিভিন্ন রকমের সুতো দিয়ে পাখার উপরে নকশা করা হয়। ফলে, পাখাটি দেখতে কোনটা লুডুর বোর্ডের মত হয়, আবার কোনটা বিভিন্ন জ্যামিতিক আকার নেয়। কোথাও কোথাও আবার এই পাখার মধ্যে জোড়া হাঁস, জোড়া ময়ূর দেখতে পাওয়া যায়। নকশী পাখার নকশা অনুযায়ী এর বিভিন্ন নামকরণ করা হয়েছে, যেমন- শঙ্খলতা, কাঞ্চনমালা, ছিটাফল, মনবিলাসী, পালংপোষ, গম্বুজ তোলা, ১৬ বুড়ির ঘর ইত্যাদি।
৩. কাগজের পাখা-
সাধারণত রঙিন কাগজ দিয়ে পাখা তৈরি করা হয়। ছোটবেলার খেলার ছলে শিশুরা অনেক সময় এই পাখা বানিয়ে থাকে।
৪. ঘোরানো পাখা -
এই পাখাগুলো দেখতে একটু মজার হয়। সাধারণত হাতপাখার ক্ষেত্রে একটি বড় দন্ড থাকে, যেটা হাতের মুঠোয় ধরে হাওয়া খেতে হয়। তবে ঘোরানো পাখাগুলির ক্ষেত্রে এটি সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়। বাঁশের টুকরো করে সেটিকে ভালো করে পরিষ্কার করে একটি নল আকারে গড়ে নেওয়া হয়। তারপরে এই পাখা দণ্ডটি ওই বাঁশের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ফলে যে কেউ খুব কম শক্তি ব্যয় করে হাওয়া খেতে পারে।
৫. কাপড়ের পাখা-
এই পাখাগুলি দেখতে খুব সুন্দর হয়। কাপড়ের ওপর নানা রকম কারুকার্য করে বা সেলাই করে পাখাগুলি তৈরি করা হয় এবং তার পাশ দিয়ে কাপড়ের কুচি লাগানো হয়। অনেক সময় শৌখিন ব্যক্তিরা এই সমস্ত পাখাগুলি কিনে ঘর সাজায়।
৬. প্লাস্টিকের পাখা-
বর্তমানে প্লাস্টিকের পাখার প্রচলন সবথেকে বেশি। এগুলি বিভিন্ন রঙের হয়। তবে এর মধ্যে কারুকার্য দেখতে পাওয়া যায় না।
৭. ভাঁজ পাখা-
এই পাখাগুলো দেখতে খুব সুন্দর হয় এবং নানা রকমের কারুকার্য করা থাকে। কখনও কখনও কোনও সুন্দর দৃশ্য বা ছবি পাখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। পাখাগুলি ছোট থেকে বড় সব আকারের পাওয়া যায়। শুধু বাতাস করার জন্য নয়, এই পাখা ঘরে সাজিয়ে রাখা হয়।
তবে বর্তমানে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের জন্য হাতপাখার ব্যবহার খুব একটা চোখে পড়ে না। তাই এই দ্রব্যের উৎপাদন প্রক্রিয়া ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ফলত, গ্রাম বাংলার এই লোকশিল্প আজ প্রায় বিপন্নতার পথে।