রাঢ় অঞ্চলে দামোদর নদের তীরে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত বর্ধমান শহরটি কৃষি প্রধান অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এটি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিভাগের একটি জেলা এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। বর্ধমান জেলার প্রধান ফসল হল ধান। তবে ধান ছাড়াও এখানে পাট, আলু, পিঁয়াজ ইত্যাদি ফসল চাষ করা হয়। তাই এই স্থান শস্য ভান্ডার বলেও পরিচিত। বর্ধমানের ধাত্রীগ্রাম তাঁতের কাপড়ের জন্য বিখ্যাত।
নামকরণ-
বর্ধমানের নামকরণ নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মতভেদ। কেউ কেউ মনে করেন জৈন তীর্থঙ্কর বর্ধমান মহাবীর-এর নামে এই শহরের নামকরণ হয়েছে। আবার কারও কারও মতে আর্য সভ্যতা বিকাশের সময় উন্নতি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে নামকরণ করা হয় বর্ধমান ।
বর্ধমানের ইতিহাস-
পূর্বে বর্ধমান জেলার রাজধানী ছিল মুঘল। তখন এই শহরের নাম ছিল শরিফাবাদ। ১৭৬০ সালে মীরকাশিম বর্ধমান জেলা ব্রিটিশদের হস্তান্তরিত করে এবং এরপর এটি জেলা সদরে পরিণত হয়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এই শহরের নাম আজও গৌরবোজ্জ্বল। বর্ধমানের প্রথম রাজা ছিলেন মহারাজ তিলকচাঁদ। এরপর তাঁর বংশের দু’জন উত্তরাধিকারী প্রতাপচাঁদ এবং মহাতাবচাঁদ রাজা হন। ব্রিটিশ আমলের মহারানী বেনদেয়ী তাঁর এক দেওয়ানের পুত্র বিজনবিহারীকে দত্তক নেন এবং তিনি বিজয়চাঁদ নামে বর্ধমানের সিংহাসনে বসেন।
-:বর্ধমান জেলার কিছু বিখ্যাত ভ্রমণ কেন্দ্র:-
এই পার্কটি রমনা বাগান নামে পরিচিত। এখানে বিভিন্ন রকমের গাছপালা, জীবজন্তু, পাখি ও নানারকম কীটপতঙ্গ রয়েছে। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ সম্পন্ন এই পার্কের প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা এবং ছোটদের জন্য ৫ টাকা। প্রতিদিন সকাল ন'টা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি এই পার্কটি খোলা থাকে। তবে বৃহস্পতিবার এটি বন্ধ থাকে।
বিজ্ঞান যারা ভালবাসেন তাদের জন্য এটি একটি অনবদ্য জায়গা। বৈজ্ঞানিক জিনিসপত্র দ্বারা নির্মিত এই জায়গাটিতে রয়েছে ছোটদের এবং বড়দের মনোরঞ্জনকারী বিভিন্ন বিষয়। হাততালি দিয়ে গাছে লাইট জ্বালানো, যন্তর-মন্তর, গাছের সামনে লাফিয়ে নিজের উচ্চতা মাপা এই সমস্ত জিনিসগুলির মধ্যে দিয়ে আনন্দ উপভোগ করতে অবশ্যই আসতে হবে বর্ধমানের এই বিজ্ঞান কেন্দ্রে। এছাড়াও তারামণ্ডল এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন থ্রিডি শো এখানে দেখানো হয়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন জিনিসের উপর হাতে কলমে পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ রয়েছে এখানে। বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের মূর্তি, রয়েছে একটি বড় ডাইনোসর। প্রবেশ মূল্য ২০ টাকা। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত এই কেন্দ্রটি খোলা থাকে। তবে শোগুলি দেখার জন্য আলাদা আলাদা টিকিট কাটতে হয় ।
রমনা বাগানের পাশেই এই প্ল্যানেটোরিয়াম অবস্থিত। এখানে প্রতি ঘন্টায় বিভিন্ন রকমের বিষয়ের উপর শো দেখানো হয়। প্রবেশমূল্য ৪০ টাকা। সকাল ১২.৩০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এটি খোলা থাকে।
বর্ধমানের অন্যতম একটি জায়গা হল ১০৮ শিব মন্দির। একটি পুকুরকে কেন্দ্র করে মন্দিরগুলি গড়ে উঠেছে এই স্থানে। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এবং বিকেল ৩টে থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এই মন্দির খোলা থাকে।
১৯০৪ সালের মহারাজ বিজয় চন্দ মাহাত লর্ড কার্জনের এ দেশে ঘুরতে আসার চিহ্ন হিসেবে এই গেটটি প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতার পরবর্তী বিজয় তোরণ নামে পরিচিত হলেও কার্জন গেট কিন্তু আজও সকলের কাছে জনপ্রিয় । ১৯৭৪ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার জনসম্পদ বিভাগের দ্বারা এটি সংরক্ষিত হয়েছে। কার্জন গেট এর ঠিক বিপরীতে রয়েছে গির্জা।
বর্তমানে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিনত হয়েছে। এই রাজবাড়িটি ভিতরে প্রবেশ করলে বোঝা যায় যে পুরাতন এবং নবীন কীভাবে মেলবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। ১৮৪০ সালে বর্ধমানের মহারাজা মহাতাব চাঁদ রাজপ্রাসাদ প্রতিষ্ঠা করেন। তাই এটির অন্য নাম মমতাব মঞ্জিল। ইতালীয় স্থাপত্যের কারুকার্য এবং স্তম্ভ দিয়ে তৈরি হয়েছে এই প্রাসাদটি। ১৯৫৮ সালে বর্ধমানের রাজপরিবার এই রাজবাড়িটি সরকারের হাতে অর্পণ করেন।
তারপর এখানে ১৯৬০ সালে ১৫ই জুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ভিতরে রয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একটি মূর্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝখানের প্রশস্ত পথ ধরে আপনি এই রাজবাড়ি অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়টি ঘুরে দেখতে পারবেন।
এটি বর্ধমান জেলার অন্যতম প্রাচীন মন্দির। ১৭০২ সাল থেকে ১৭৪৭ সালের মধ্যে মহারাজা কার্তিক চন্দ্র- এর দ্বারা নির্মিত হয় এই মন্দিরটি। এখানে প্রতিষ্ঠিত দেবী অষ্টভূজা। তবে প্রচলিত আছে এই দিদি পদতলে এমন কিছু শব্দ লেখা আছে যার পাঠোদ্ধার এখনো সম্ভব হয়নি। মন্দিরের গায়ে সুন্দর কারুকার্য রয়েছে।
৮. হজরত পীর খক্কর শাহ-
জাতি-ধর্ম-বর্ণের মেলবন্ধন ঘটে এই স্থানে। ভিতরে রয়েছে একটি গাছ যার তলা দিয়ে গেলে আপনার মনষ্কামনা পূর্ণ হবে। এখানে পীর বাবাদের আশীর্বাদ পাওয়া যায়।
৯. শের আফগানের সমাধি-
এখানে শের আফগান, নবাব কুতুবউদ্দিন আইবক পীর বহরম সক্কা-এর সমাধি রয়েছে। এই জায়গাটি বর্তমানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধীনে রয়েছে।
বর্ধমানেশ্বর নামে পরিচিত এই শিবলিঙ্গটি খুব মোটা এবং বড় হওয়ায় এটিকে মোটা শিব মন্দির বলা হয়। বহু মানুষ দূরদূরান্ত থেকে শিব মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন্য ছুটে আসেন।
কীভাবে বর্ধমান পৌঁছবেন-
হাওড়া থেকে ট্রেনে করে বর্ধমান পৌঁছনো যায়। এছাড়াও কলকাতা থেকে বর্ধমান যাওয়ার বিভিন্ন সময় বাস রয়েছে।