সমগ্র বিশ্বজুড়ে সমস্ত বাঙালি প্রতিবছর ২৫ শে বৈশাখ অর্থাৎ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আরও একবার কবিগুরুকে স্মরণ করেন । বাঙালির আবেগ, মননে, অন্তরের এক্কেবারে গহীনে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে কবির লেখনী, গান, ইত্যাদি ।
রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে কিছু কথা -
১৮৬১ সালে ৭ই মে এবং বাংলা ক্যালেন্ডার হিসেবে ১২৬৮ সালে ২৫শে বৈশাখ তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত কলকাতা শহরের জোড়াসাঁকো অঞ্চলে ঠাকুর পরিবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। ঠাকুর পরিবারের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে জানা যায়, বাংলায় নবজাগরণের ক্ষেত্রে ঠাকুর পরিবার অবদান সম্পর্কে । তাই পূর্বপুরুষদের মতো রবি ঠাকুর ও রেনেসাঁর অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন ।
মাত্র ৮বছর বয়স থেকে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ষোলো বছর বয়সে কবির লেখা কবিতা ছাপা হয়, আর এইভাবেই তাঁর লেখার যাত্রার সূচনা হয়। জীবনস্মৃতি নামক গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন ছোটবেলা থেকেই কবির একটি বদ্ধ কক্ষে পড়াশোনার ক্ষেত্রে মন বসতো না। তাই ছুটির সুযোগ পেলেই তিনি বোলপুর কিংবা পানিহাটি চলে যেতেন ।
এই বদ্ধঘরে স্কুলজীবনের একঘেয়েমি কাটানোর জন্যই ১৯০১সালে তিনি শান্তিনিকেতনে একটি আশ্রম তৈরী করেন, যা পরবর্তী কালে বিশ্বভারতী নামে পরিচিতি পায় ।
১৯১৩ সালে কবি সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার পান । কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের স্বৈরাচারী স্বভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তিনি স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। পরিশেষে ১৯৪১ সালের ২২শে শ্রাবণ কবিগুরুর জীবনাবসান হয়।
ঠাকুর পরিবারের বংশ পরম্পরার অবস্থান এবং রবি ঠাকুরের জন্মভিটে বলতে যা বোঝায় সেটি হল জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি। বাংলার ইতিহাসের সাক্ষীবহ এই বাড়িতে আপনি দেখতে পাবেন ৭০০ বছরের প্রাচীন ছবি । এছাড়াও এখানে রবীন্দ্রনাথের হাতে আঁকা ছবির ও সন্ধান পেয়ে যাবেন । জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির মিউজিয়ামটি ছবি, পাণ্ডুলিপি, বই এবং প্রাচীন আসবাব পত্র মিলিয়ে মোট তিনটি অংশে বিভক্ত ।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এই জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি নির্মাণ করা হয় ১৭৮৪ সালে । বর্তমানে সম্পূর্ণ বাড়িটি রবীন্দ্রভারতী মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে । এই বাড়িটি কলকাতার দর্শনীয় ভ্রমণ স্থানের অন্যতম ঠিকানা হয়ে উঠেছে ।
দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য এখানে লাইট এবং সাউন্ড শো এর আয়োজন করা হয়েছে, যা সন্ধে ৭টা থেকে ৮.৪০ পর্যন্ত আয়োজিত হয় ।
সময়সীমা - সোমবার ছাড়া সপ্তাহের প্রত্যেক দিন সকাল ১০.৩০ থেকে বিকেল ৪.৩০ পর্যন্ত দর্শকদের জন্য খোলা আছে ।
প্রবেশমূল্য - জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি দর্শনের জন্য -
ভারতীয় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রবেশমূল্য - ১০টাকা
ছাত্র-ছাত্রীদের প্রবেশমূল্য - ৫ টাকা
বিদেশী পর্যটকদের প্রবেশমূল্য - ৫০টাকা
কীভাবে যাবেন -
ট্রেনে - ট্রেনে চেপে হাওড়া স্টেশন পৌঁছে, গাড়ি ভাড়া করে মাত্র ১৫মিনিটের দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে ।
সড়কপথে - কলকাতা শহরের যেকোনো স্থান থেকে গাড়ি ভাড়া করে খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ।
কলকাতা শহর থেকে ১৫২কিমি অদূরে বীরভূম জেলায় অবস্থিত বোলপুর বা শান্তিনিকেতন । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের পিতাই হলেন এই শান্তিনিকেতনের সৃষ্টিকর্তা । পরবর্তীকালে এই অঞ্চলেই রবীন্দ্রনাথ আশ্রম গড়ে তোলেন এবং বর্তমানে যা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত ।
রবি ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত এই শান্তিনিকেতনের দর্শনীয় স্থান গুলি হল -
১. বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় -
রবীন্দ্রনাথ নির্মিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত কলেজ হিসেবে পরিচিত ছিল ।১৯৫১সালে পার্লামেন্টের অ্যাক্ট অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয় । বর্তমানে এখানে ১০+ ২ স্তর থেকে গ্রাজুয়েশন এমনকি পিএইচডি স্তর পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা উপলব্ধ আছে ।
২. ঠাকুর আশ্রম -
শান্তিনিকেতনের এই আশ্রমেই রবীন্দ্রনাথ বসবাস করতেন । এই বাড়িটি ১৮৬৩ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নির্মাণ করেন ।বর্তমানে এই বাড়িটিকে কেন্দ্র করে একটি মিউজিয়াম গঠন করা হয়েছে ।
সময়সীমা - আশ্রম পরিদর্শনের সময়সীমা হল দুপুর ২টো থেকে বিকেল ৪.৩০।
প্রবেশমূল্য - প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের আশ্রম দর্শনের মূল্য হল - ৪০টাকা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের দর্শনের প্রবেশমূল্য হল - ১০ টাকা
৩. রবীন্দ্রভবন মিউজিয়াম -
রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় কীর্তি থেকে শুরু করে চিঠিপত্র, ছবি এমনকি নোবেল পুরস্কার ও এই মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে ।
৪. ছাতিমতলা -
এই স্থানে রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ধ্যানস্থ থাকতেন ।
রবীন্দ্রনাথ নিজেও বিশ্বাস করতেন একমাত্র ধ্যানই উন্নতির প্রধান হাতিয়ার । তাই এখানে একটি প্রার্থনা গৃহ ও রয়েছে, যেখানে আজও ছাত্র-ছাত্রীরা ধ্যানমগ্ন থাকেন ।
কীভাবে যাবেন -
ট্রেনে - হাওড়া থেকে বিশ্বভারতী এক্সপ্রেস বা কবিগুরু এক্সপ্রেস ধরে খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন শান্তিনিকেতনে ।
সড়কপথে - কলকাতা থেকে গাড়ি ভাড়া করে প্রায় ৪ ঘণ্টার দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে ।
রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব-
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিবস হিসেবে প্রতিবছর ২৫শে বৈশাখ দিনটিতে জোড়াসাঁকো ছাড়াও কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে এবং শান্তিনিকেতনে ও আড়ম্বর সহকারে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সাহায্যে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করা হয় । তবে এই বছরে করোনা পরিস্থিতির কারণে কোথাও রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করা সম্ভব হচ্ছে না ।
ট্রিপোটো এবং আপামর বাঙালির তরফ থেকে কবিগুরুর প্রতি রইল সশ্রদ্ধ প্রণাম ।