প্রতি বছর বৈশাখ মাসের পূর্ণিমার দিন পালিত হয় বুদ্ধ পূর্ণিমা, যা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে বছরের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে বিশেষভাবে এই পুণ্যতিথি পালন করা হয়। ভারতবর্ষের বাইরে অধুনা নেপালে, যা এককালে পরিচিত ছিল লুম্বিনী নামে, মহা ধুমধাম সহকারে সারা দিন ধরে এই উৎসব পালন করা হয়। তাছাড়াও যে সব দেশে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব রয়েছে অর্থাৎ সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, মায়ানমার, ভিয়েতনাম জাতীয় জায়গাতেও এই উৎসব মানুষদের খুব প্রিয় এবং কাছের। বৌদ্ধধর্মের উৎসস্থল হিসেবে ভারতের যে সকল স্থানে বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে বিশেষ অনুষ্ঠান সংগঠিত হয় এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে যে স্থান গুলি সবসময়ই আলাদা গুরুত্ব পেয়ে থাকে, আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই সকল জায়গাগুলি সম্পর্কে।
সাঁচি স্তূপ, মধ্যপ্রদেশ
বৌদ্ধধর্মের অন্যতম এই পীঠস্থান তৈরি হয়েছিল সম্রাট অশোকের সময়কালে, ৩য় শতাব্দীতে। পরবর্তী সময়ে জায়গাটি লাভ করেছে সাতবাহন বংশের শাসকদের সহযোগিতা। মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে আঁকা রয়েছে বুদ্ধের জীবন এবং জাতকের জীবনের নানান গল্প বা বাণী দিয়ে। অসাধারণ সুন্দর, এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেলে অলঙ্কৃত এই মনুমেন্টটি পেয়েছে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের সম্মানও।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, বিহার
প্রাচীন ভারতীয় সমাজের বিশ্বব্যাপী খ্যাতির পিছনে ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসীম অবদান। বিশ্বমানের এই বিদ্যালয়ে ধর্ম, শাস্ত্র, বিজ্ঞান, সকল রকম বিষয়েই বহু ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়া হত। বিশ্বের দরবার হতে বহু বিদেশী শিক্ষার্থী এখানে আসতেন বিদ্যাচর্চা করতে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছিলেন স্বয়ং বুদ্ধদেব, মহাবীর এবং সম্রাট অশোক। নালন্দার অবশিষ্ঠ ধ্বংসাবশেষ দেখে অনুমান করা যায় যে এককালে কত সুন্দর ছিল জায়গাটি। বৌদ্ধ ধর্মের আন্তর্জাতিক বিস্তার এবং গৌরবের মূর্ত নিদর্শন এই বিশ্ববিদ্যালয়।
রুমটেক মনেস্ট্রি, সিকিম
বৌদ্ধ ধর্ম যে ভাবে প্রাচীন তিব্বতের মাটিতে এবং মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিল তা উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালে তিব্বত থেকেই আবার বৌদ্ধ ধর্মের পরিবর্তিত রূপ ছড়িয়ে পরে উত্তর পূর্ব ভারতে এবং বিশেষ করে সিকিমে। সিকিমে বর্তমানে রয়েছে প্রায় ২০০র বেশি গুম্ফা, যার প্রায় সবকটিতেই আজও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকেন, শিক্ষা এবং দীক্ষা লাভ করেন এবং কৃচ্ছসাধন করেন। গ্যাংটক হতে অনতিদূরে রুমটেক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মোনাস্ট্রি যার স্থাপত্যগত সৌন্দর্যকে টেক্কা দিতে পারে একমাত্র তার চারপাশের জঙ্গলমণ্ডিত পাহাড়ের অপরূপ শোভা। বুদ্ধপূর্ণিমার সময়ে নানান অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় এই গুম্ফায়, যার কিছু কিছু দর্শকরাও দেখতে পারেন সরাসরি।
লেহ লাদাখের হেমিস মনেস্ট্রি
লাদাখের শুষ্ক এবং তীক্ষ্ণ সৌন্দর্যের মধ্যে আমরা খুঁজে পাই এমন এক দল মানুষকে, যারা প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝেও হাসিমুখে বছরের পর বছর এখানে জীবনযাপন করছেন। এই বৌদ্ধ পরিবরগুলির সদস্যদের সাহস এবং শক্তি যোগায় ভগবান বুদ্ধের প্রতি এনাদের আস্থা এবং ভালোবাসা । এবং এই ঘটনার একটি নিদর্শন হল লেহ্ থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হেমিস মোনাস্ট্রিটি। ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন লাদাখের রাজা সেঙ্গে নামগিয়াল এই মনেস্ট্রিটির গোড়াপত্তন করেন। ভারতবর্ষের ধনীতম মোনাস্ট্রি হিসাবেও এই জায়গাটি পরিচিত।
অধুনা চিন-অধিকৃত তিব্বতের সাংস্কৃতিক এবং প্রশাসনিক রাজধানী ছিল লাহসা নামক শহরটি, এবং এই নামটির আক্ষরিক অর্থ "ইশ্বরের বাসস্থান"। রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় কারণে তিব্বতি ধর্মগুরু দলাই লামার বর্তমান আশ্রয় ভারতবর্ষের হিমাচল প্রদেশে। শ্রদ্ধেয় চতুর্দশ দলাই লামা ধর্মশালা ও ম্যাকলিওডগঞ্জে বিগত ৬০ বছর ধরে বসবাস করেন, তাঁরই সঙ্গে ভারতবর্ষে এসেছিলেন প্রায় ১০০০০ বৌদ্ধ তিব্বতি, তাঁরাও থাকেন এখানে। ম্যাকলিওডগঞ্জের মনেস্ট্রিটিই বর্তমানে তাঁর দীর্ঘস্থায়ী বাসস্থান হওয়ায় পরিচিত হয়েছে লিটল লাহসা নামে।
বোধগয়া বা বুদ্ধগয়া, বিহার
গৌতম বুদ্ধের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত যে চারটি স্থান তীর্থক্ষেত্র হিসেবে বৌদ্ধদের কাছে সম্মানিত, বোধগোয়া তাদের মধ্যে অন্যতম (বাকিগুলি যথাক্রমে লুম্বিনী, সারনাথ এবং কুশিনগর)। ২০০২ সালে এই স্থানে অবস্থিত মোহাবধি মন্দির পেয়েছে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের সম্মান। কথিত আছে এই অঞ্চলের বিখ্যাত বোধিবৃক্ষের ছায়ায় তপস্যারত থাকাকালীন বুদ্ধদেব মোক্ষলাভ করেছিলেন। মহাবোধি মন্দিরের ঠিক পাশেই রয়েছে ৮০ ফুট উঁচু বুদ্ধ মূর্তি, যা হয়ে উঠেছে দর্শনার্থীদের খুব প্রিয়।