বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনাস্থল হিসেবে মোনাস্ট্রি বা গুম্ফাগুলির গুরুত্ব এবং অবদান অনস্বীকার্য। সিকিম জুড়ে ছড়িয়ে আছে প্রায় ২০০টির মতো গুম্ফা। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে থাকার জন্যে নয়, গুম্ফাগুলি বিখ্যাত তাদের ইতিহাস, স্থাপত্যশৈলী এবং সিকিমের জনগণের প্রতি তাদের অবদানের কারণে। বহু শতাব্দী ধরে সিকিমের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষদের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক সম্প্রীতির পিছনেও গুম্ফাগুলির অবদান যথেষ্ট। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে তৈরি কোন কোন গুম্ফা সিকিমে গিয়ে দেখতেই হবে? আসুন, দেখে নিন আমাদের এই তালিকা থেকে।
রুমটেক মনেস্ট্রি
সিকিমের অন্যতম বিখ্যাত মনেস্ট্রি রুমটেক স্থাপিত হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে, নবম কর্মপা ওয়ানচুক দর্জির তত্বাবধানে। পূর্ব সিকিমের এই গুম্ফাটি ধর্মচক্র কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত। গ্যাংটক থেকে মাত্র ২৩ কিমি দুরত্বে অবস্থিত এই গুম্ফাটি গ্যাংটক সাইটসিয়িং-এর একটি প্রধান আকর্ষণ। এই গুম্ফার স্থাপত্য এবং সৌন্দর্য অত্যন্ত নান্দনিক।
লিংদুম মনেস্ট্রি
গ্যাংটকের কাছেই, মাত্র ২০ কিমি দূরে অবস্থিত পূর্ব সিকিমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গুম্ফা হল লিংদুম মোনাস্ট্রি। স্থানীয়রা রানকা গুম্ফা বলেও এটিকে অভিহিত করেন। মজার ব্যাপার হল, এটি সিকিমের নবীনতম গুম্ফাগুলির মধ্যে একটি, যা স্থাপিত হয়েছে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে। চারিপাশে পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে বিশাল এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই গুম্ফাটি অল্পকিছুদিনের মধ্যেই পর্যটকদের অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠেছে।
দো-দ্রুল-চর্তেন মনেস্ট্রি
গ্যাংটক থেকে পায়ে হেঁটেই পৌঁছে যেতে পারেন এখানে, যা শহরকেন্দ্র হতে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ভূতপূর্ব রিমপচে এবং ত্রুলিশির নির্দেশে এই গুম্ফাটি তৈরি হয়েছিল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে। গুম্ফাটিতে সাজানো রয়েছে ১০৮টি মনি লাখর বা প্রেয়ার হুইল। প্রেয়ার হুইলগুলিতে খোদাই করা থাকে বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্ত্র। বোধিসত্ত্ব অর্চনাকালে এই প্রেয়ার হুইলগুলি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রার্থনা করা হয়। সিকিমের অধিবাসীরা এই গুম্ফাকে প্রচন্ড জাগ্রত মনে করেন।
এনচে মনেস্ট্রি
প্রায় দুই শতাব্দী প্রাচীন এই গুম্ফাটিও রয়েছে গ্যাংটক থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে। পায়ে হেঁটে বা লোকাল ট্যাক্সি করে সহজেই আপনি এই সকল মনেস্ট্রিগুলি একইদিনে পর পর ঘুরে আসতে পারবেন। বজ্রযান বৌদ্ধ মতাবলম্বীদের প্রয়োজনে বৌদ্ধতন্ত্র সম্রাট দ্রূপতব কার্পো এই গুম্ফাটিকে তন্ত্রসিদ্ধ করেন। এনচে মোনাস্ট্রির নামের আক্ষরিক অর্থ হল "একমাত্র মন্দির"। ভিতরে পূজিত হন লোকি শরিয়া, বুদ্ধদেব এবং গুরু পদ্মসম্ভব। সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক দিক থেকে একটি সিকিমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গুম্ফা, যা পর্যটকদের অবশ্যই যাওয়া উচিত।
তাশিডিং মনেস্ট্রি
রথং এবং রঙ্গিত নদীর মাঝের পর্বতচূড়ার একেবারে ওপরে, ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে স্ঠাপুট হয়েছিল তাশিডিং গুম্ফা। শীতকালে গুম্ফার চারিদিকে বরফে ঢাকা চূড়াগুলি সৌন্দর্যের অন্য মাত্রা এনে দেয়। গুম্ফাটিতে বসবাস করেন প্রায় ৭০ জন বৌদ্ধ মঙ্ক বা ভিক্ষু, যারা তিনশ বছরের প্রথা মেনে নিজেদের দীক্ষা গ্রহণ করছেন। তিব্বতী ক্যালেন্ডারের প্রথম মাসে এখানে বুমচু উৎসব উদযাপিত হয়, যা পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
লাবরং মনেস্ট্রি
উত্তর সিকিমের গভীরে, ফোদং মনেস্ট্রি অতিক্রম করে আরও ২ কিলোমিটার ভিতরে গেলে দেখা পাবেন এই মোনাস্ট্রিটির যা উত্তর পূর্ব সিকিমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কেন্দ্র। তিব্বতের কংপুর লাৎসুন চেম্বর স্মৃতির উদ্দ্যেশে তৈরি হয়েছিল এই গুম্ফাটি। লাবরাং কথাটির অর্থ যেখানে লামাদের বসবাস। নিংমাপা বৌদ্ধ দের প্রধান ধর্মকেন্দ্রও এটি। গুম্ফাটির অবস্থান, পারিপার্শ্বিক নির্জনতা এবং স্থাপত্যের সৌন্দর্য এনে দেয় অপার মুগ্ধতা এবং শ্রদ্ধা। নীরবে নির্জনে কিছু সময় কাটালে নিশ্চই পাওয়া যাবে ক্লান্তিহীন প্রশান্তির সন্ধান।
জং দগ পালরি ফো-বরাং মনেস্ট্রি
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে, স্থাপিত হওয়ার প্রায় ৬ বছর পরে, দুর্পিন দারার চূড়ায় এই গুম্ফার অভিষেকপত্তন করেছিলেন স্বয়ং দলাই লামা। সাথে নিয়ে এসেছিলেন বৌদ্ধদের কাছে পবিত্র কুনগুয়ার, ১০৮টি খণ্ডে রচিত তিব্বতী ধর্মীয় পুঁথি, যা এখনও রাখা আছে এখানে। ভাগ্যবান পর্যটকরা পান চাক্ষুস দর্শন। গুম্ফার ভিতরে দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা রয়েছে নানান তিব্বতি শিল্পকলা। গুম্ফা হতে চারিপাশের পাহাড় এবং জঙ্গলের প্রাকৃতিক শোভা অপরিসীম।
কার্তক মনেস্ট্রি
পেলিং হতে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইউকসাম সিকিমের অন্যতম সুন্দর এবং নান্দনিক পর্যটনকেন্দ্র। ইউকসামের কার্তক লেকের সামনেই অবস্থিত লাল রঙের অত্যন্ত সুন্দর কার্তক মনেস্ট্রি। পশ্চিম সিকিমের অন্যতম সুন্দর এবং ধর্মীয় দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ গুম্ফা হল কার্তক গুম্ফা, সামনের কার্তক লেক যাকে এনে দিয়েছে অন্য মাত্রা।