ধরুন আপনাকে কেউ জিজ্ঞেস করল এই পৃথিবীতে মহাদেশের সংখ্যা কয়টি? আপনিও মুচকি হেসে বলে দিলেন ৭টি। কিন্তু এইখানেই করে ফেললেন বড়সড় একটি ভুল। কারণ, ২০১৭ সাল থেকে উঠে এসেছে নতুন এক ভূখণ্ডের নাম, আর তাই মহাদেশের সংখ্যা আটকে নেই মাত্র সাতটায়। জোর কদমে লড়াই চলছে নতুন ভূখণ্ড জিল্যান্ডিয়াকে অষ্টম মহাদেশ রূপে স্বীকৃতি দেওয়ার।
কী এই জিল্যান্ডিয়া
মাওরি ভাষায় এই ভূখণ্ডের নাম তে রিউ-আ-মাউই, আর ইংরেজিতে জিল্যান্ডিয়া বা তাসমানটিস নামে। আজ থেকে প্রায় ৮০ মিলিয়ন বছর আগে গন্ডোওয়ানাল্যান্ড নামক এক সুপ্রাচীন ভূখণ্ড থেকে ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া মহাদেশীয় স্তর, যা সহস্র সহস্র বছর ধরে নিভৃতে নিমজ্জিত নিউজিল্যান্ডের অদূরে, সমুদ্রের গভীরে।
বিজ্ঞানীরা বারে বারে জিল্যান্ডিয়াকে ক্লাসিফাই করতে গিয়ে বিব্রত হয়েছেন, কখনও এই অঞ্চলকে বলা হয়েছে নিমজ্জিত মহাদেশ, কখনও বা মহাদেশাংশ। এমনকি উপমহাদেশ বা সরাসরি মহাদেশ রূপেও। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানীরা অস্ট্রেলিয়ার সমআয়তনের এই ভূখণ্ডকে জিল্যান্ডিয়া নাম দেন এবং শোরগোল ফেলে দেন বৈজ্ঞানিক মহলে।
ইতিহাসের চোখে জিল্যান্ডিয়া
ফিরে যাই অতীতের দিকে, তবে না, ৮০ মিলিয়ন বছর নয়, ফিরে যাই প্রায় ৪০০ বছর আগে। ৪০০ বছর আগে যখন পৃথিবী নতুন ভাবে "আবিষ্কৃত" হচ্ছে। দুর্বার নির্ভীক অভিযানকারীরা জাহাজে করে বেড়িয়ে পড়ছেন পৃথিবীর অচেনা জায়গাগুলি খুঁজে বার করার জন্যে। সঙ্গে থাকছে কারটোগ্রাফাররা, যারা রচনা করেন মানচিত্র। উদ্দেশ্য পৃথিবীর প্রতিটি সমুদ্র, প্রতিটি ভূখণ্ডকে খুঁজে বার করা, চিহ্নিত করা।
এই নাবিকদের মধ্যেই প্রথম দেখা গিয়েছিল আবেল তাসমানের । নিমজ্জিত এই মহাদেশ উদ্ধারের প্রথম প্রচেষ্টা করেছিলেন তিনিই। ১৬৪২ সালে এই মহাদেশ খুঁজে বের করার প্রতিজ্ঞা করে তিনি বেড়িয়ে পড়েন। পাল তুলে বছরের পর বছর নোনা জলের সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিলেন অসম যুদ্ধ। অবশেষে তিনি পৌঁছান ওশিয়ানিয়াতে, অর্থাৎ যা আমরা চিনি অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড রূপে। ক্ষান্ত হলেন তিনি, ভাবলেন এই তাঁর কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য।
তবে খুব ভুল তিনি ছিলেন না। ৩৭৫ পরে বুঝতে পারা যায় যে নিউজিল্যান্ড আর কিছুই নয়, নিমজ্জিত এই জিল্যান্ডিয়া মহাদেশের একটুমাত্র অংশ, যা এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সমুদ্রস্তরের ওপরে।
জিল্যান্ডিয়ার রাজনৈতিক স্বীকৃতি
মহাদেশ খুঁজে পাওয়া গেলেও, মহাদেশকে মহাদেশ বলতে পারা নিয়ে কিন্তু হচ্ছে নানারকম অসুবিধে। মজার ব্যাপার সেই অসুবিধার বেশিরভাগটাই কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট, রাজনৈতিক। জিল্যান্ডিয়াকে, নিউজিল্যান্ড যার অন্তর্ভুক্ত, যদি মহাদেশ বলে মেনে নেওয়া হয়, তাহলে রাজনৈতিক ভাবে নিউজিল্যান্ড ওশিয়ানিয়া থেকে বেরিয়ে আসবে, অন্য মহাদেশের অংশ রূপে। যার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ওশিয়ানিয়ার অভ্যন্তরীণ সম্পর্কে এবং নানান অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। তাই ভৌগোলিকভাবে মহাদেশ প্রমাণিত হওয়ায় পরেও, রাজনৈতিকভাবে মহাদেশ নামে অভিহিত হতে পারছে না জিল্যান্ডিয়া। এইভাবেই মানুষের কাছে পরাস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক সত্য।
প্রায় ৪০০ বছর আগে ঝোঁকের বশে যে মহাদেশকে খুঁজতে বেড়িয়ে পড়েছিলেন তাসমান, তাঁর স্বরূপ উদ্ঘাটন হয়েছে বিংশ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে এসে। নিউজিল্যান্ডের সাধারণ মানুষ, বৈজ্ঞানিকরা এবং বুদ্ধিজীবীরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এই মহাদেশকে যোগ্য স্বীকৃতি প্রদান করার। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে, মহাদেশগুলির মহাসম্মেলনে অচিরেই যোগদান করবে জিল্যান্ডিয়া।