বর্তমানে করোনা মহামারীর সঙ্গে ১৯শতকের মহামারীর হুবহু সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তৎকালীন অফিসিয়াল রিপোর্ট অনুযায়ী বুবোনিক প্লেগের সূচনা হয় ১৮৯৬ সালে । প্রধানত চিনের হং কং প্রদেশ থেকে ১৮৯৪ সালে এই মহামারী উৎপত্তি লাভ করে । সেই সময় প্রাথমিকভাবে ভারতের বন্দর অঞ্চল যেমন বোম্বে, কলকাতা এবং করাচিতে এই মহামারীর করাল গ্রাস দৃষ্টিগোচর হয়েছিল।
রোগের লক্ষণ -
তৎকালীন ভারতীয় চিকিৎসক এ. জি. ভিগাসের একটি লেখনী থেকে জানা যায়, সেই সময় প্লেগ মহামারীর মূল লক্ষণ ছিল তীব্র জ্বর এবং টিউমারের সমস্যা। এছাড়াও অন্যান্য সমস্যাগুলি হল - লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, হাতের এবং পায়ের আঙ্গুল, ঠোঁট, নাকে ঘা সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি । আর এই ধরণের অসুখের নিরাময়ের কোনও রকম পরিকাঠামো না থাকায় রোগীরা বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারাতেন ।
সেই সময় তিলোত্তমা কলকাতা শহর প্লেগ মহামারীর প্রকোপে প্রায় বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল। আর তাই রামকৃষ্ণ মিশন দেশ সেবার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। এছাড়াও ভারতের কঠিন সময়ে মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল বা সিস্টার নিবেদিতার মতো মানুষ । নিবেদিতা ব্রিটিশ গভর্মেন্ট-এর সাহায্য ছাড়াই মানুষের সেবার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন ।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, স্কটিস- আইরিশ শিক্ষিকা এবং সমাজকর্মীর লন্ডনে প্রথম স্বামীজীর সঙ্গে পরিচয় হয় । সেই সময় স্বামীজীর বেদান্ত মতাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি স্বামীজীর শিষ্য হন এবং ১৮৯৮ সালের জানুয়ারী মাসে কলকাতায় আসেন ।
সেই সময় প্লেগ মহামারীতে গোটা কলকাতা শহর জরাজীর্ণ হয়ে পড়লে সাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্য রামকৃষ্ণ মিশন একটি কমিটি গঠন করেন যার সেক্রেটারি ছিলেন সিস্টার নিবেদিতা । রামকৃষ্ণ মিশনের সমস্ত মহারাজ, এবং স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ মানুষকে মহামারীর কবল থেকে উদ্ধারের প্রচেষ্টা শুরু করেন । এই সময় তাঁরা মানুষের সেবা করা ছাড়াও প্লেগ নামক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য প্রচার শুরু করেন ।
প্লেগ ম্যানুফেস্টো -
কলকাতার এই কঠিন পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ১৮৯৮ সালে 'প্লেগ ম্যানিফেস্টো' নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন । তবে এই লেখনীর মূল উদ্দেশ্যে হল প্লেগ রোগ সম্বন্ধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি । এই পুস্তিকা পড়লে জানা যায় সেই সময় স্বামীজী মানুষকে আতঙ্কিত না হয়ে পরিছন্ন থাকা এবং ইমিউনিটি বাড়ানোর প্রতি নজর দিতে বলছেন ।এছাড়াও দেশের সমস্ত মানুষকে একজোট হয়ে সমস্যার মোকাবিলার প্রতি নজর রাখতে বলেছেন।
স্বামীজী এই পুস্তিকাতে বলেছেন একমাত্র বিশুদ্ধ খাবার, পরিশুদ্ধ পোশাক, নিয়মিত ঘর পরিষ্কারের সাহায্যেই এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব । সেই সময় একটি গুজব প্রচলিত ছিল যে - ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন, দেশের সমস্ত মানুষকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে টিকাকরণ করেছেন । এই পুস্তিকার সাহায্যে স্বামীজী এই গুজবকে উড়িয়ে দিয়ে সমগ্র ভারতবাসীকে আশ্বাস করে বলেছেন, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে টিকা প্রদান করবেন না।পুস্তিকাতে সেই সময়ের কিছু মানুষের সাহায্যের কথা বলেছেন যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নির্দ্বিধায় মানুষের সেবার কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেছেন । সেই সময় এই পুস্তিকাটি বাংলা এবং হিন্দি দুই ভাষাতেই উপলব্ধ ছিল ।
এই পুস্তিকাটি ২০০৬ সালে বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের প্রকাশনী থেকে অদৈত্ব আশ্রম থেকে একটি মাসিক পত্রিকায় নতুনভাবে ছাপানো হয় ।