মহামারীর কবলে আক্রান্ত সারা বিশ্ব। আমেরিকা ইউরোপ সহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ করোনার ধাক্কায় বিপর্যস্ত, ভারতবর্ষেও সেকেন্ড ওয়েভের প্রাদূর্ভাবে আজ অবস্থা শোচনীয়। এরই মধ্যে আসার আলো দেখাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট একটি দেশ ইজরায়েল। ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার মাঝামাঝি সংযোগস্থলে অবস্থিত এই দেশটি গত ১০ দিনে করোনাঘটিত মৃত্যুর হাত থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্তি পেয়েছে। আসুন দেখেনি কীভাবে হয়েছে এই অসাধ্য সাধন।
ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ইজরায়েল
২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ইজরায়েল প্রতিষেধক পরিবেশনের পরিষেবা চালু করে এবং দেশের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক জনগণকে এই উদ্যোগের আওতায় আনা হয়। এরফলে বর্তমানে এক কোটি জনসংখ্যা বিশিষ্ট এই দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার সিংহভাগ ভ্যাক্সিন গ্রহণ করেছেন। এর ফলে বর্তমানে বাড়ির বাইরে, রাস্তাঘাটে এবং অন্যান্য জনস্থানে মুখোশ পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হয়েছে। তবে শপিং মল বা সিনেমা হল জাতীয় বদ্ধ জনস্থানে এখনো মুখোশ পরা বাধ্যতামূলক।
ইজরায়েলের বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় ৮১% ষোলো বছরের বেশি বয়স্ক, এবং সরকারের পক্ষ থেকে এদেরকেই আনা হয়েছে টিকাকরণ উদ্যোগের আওতায়। দেওয়া হয়েছে ফাইজার এবং বায়োএনটেক ভ্যাক্সিন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসকরা লক্ষ্য করেছেন যে মহামারীর প্রসার হ্রাস পেয়েছে। বহু অংশে কমে গেছে হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ভর্তি হতে আগ্রহী রুগীদের সংখ্যা। মেডিক্যাল অক্সিজেনের আকালও একেবারেই দেখা যায়নি এই দেশে। ফলত ভ্যাক্সিন ব্যবহারের সাকসেস স্টোরি হিসাবে সমগ্র বিশ্বের দরবারে হাজির হয়েছে ইজরায়েলের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই।
সংখ্যার দিক থেকে বিচার করলে গত কয়েক সপ্তাহে গড় দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা ১০০০০ থেকে হ্রাস পেয়ে হয়েছে মাত্র ৮৫। হাসপাতাল নার্সিংহোমের শোচনীয় অবস্থার রুগীদের সংখ্যাও নেমে এসেছে শূন্যের কাছাকাছি। ফলে অপৎকালীন অবস্থায় যে সকল হাসপাতালগুলিকে ইমার্জেন্সি সেন্টার ঘোষণা করা হয়েছিল, সেগুলিও ক্রমে ফিরে আসছে নিজেদের সাধারণ রূপে। ফলস্বরূপ দেশ জুড়ে খুলছে স্কুল কলেজ, রেস্টুরেন্ট বা বাজার হাট।
ইজরায়েল ও করোনা : কী হবে ভবিষ্যৎ
অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু প্যান্ডেমিককে লঘু করে দেখার কোনও ভাবনা নেই ইজরায়েলবাসীদের। বিদেশ হতে আগত ব্যক্তিরা শুধুমাত্র জরুরিভিত্তিতেই ইজরায়েল ঢুকতে পারবেন আপাতত। যে সকল ইজরায়েলবাসী ইজরায়েলের বাইরে বসবাস করছেন বা আটকে আছেন এবং এখনও ভ্যাক্সিন নিয়ে উঠতে পারেননি, তাঁদেরকে দেশে ঢোকার পর ভ্যাক্সিন দেওয়া হচ্ছে এবং আইসোলেট করে রাখা হচ্ছে। যদিও এতে ভাইরাসের কোনও অচেনা স্ট্রেনের ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সারাবিশ্বের পরিস্থিতি নজরে রেখে তাই এখনও ইজরায়েল সরকার দেশকে প্যান্ডেমিক মুক্ত ঘোষণা করেনি।
এরই মধ্যে আরেকটি আশঙ্কার কারণ হচ্ছে ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে চলমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি নিয়ে। প্যালেস্টাইন, গাজা অঞ্চল এবং ইজরায়েলের চারপাশের বিভিন্ন দেশে কিন্তু করোনার সংক্রমণ এখনও হ্রাস পায়নি, তাই এই বিষয়ে সতর্কতা মেনে চলা হচ্ছে।
হার্ড ইমিউনিটির পথে ইজরায়েল
প্রশ্ন উঠছে ইজরায়েল কি আস্তে আস্তে হার্ড ইমিউনিটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? কারণ বিগত কয়েক মাসে সংক্রমণের সংখ্যার তুলনায় যারা আরোগ্য লাভ করেছেন, তাদের সংখ্যা অনেকটাই বেশি। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বের বাকি দেশগুলি তাকিয়ে আছে ইজরায়েলের দিকে, ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতার ফলাফল দেখতে সকলেই আগ্রহী। প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধ বয়সগোষ্ঠীর মানুষদের ভ্যাক্সিন দেওয়া এবং তারপরে তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থার উপর যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে, তার উপর নির্ভর করে রয়েছে ইউরোপ এবং এশিয়ার বাকি দেশগুলিও।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে ২০২০ এর শেষ ভাগে অর্থাৎ মাস ভ্যাক্সিনেশন ড্রাইভ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত ইজরায়েলের কোভিড সংক্রমণ মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে চলেছিল এবং প্রতিদিন অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। মনে করা হচ্ছে যে জানুয়ারি মাসে ভ্যাক্সিন দেওয়া শুরু করাই এই সংক্রমণ হ্রাসের মূল এবং আপাতত একমাত্র কারণ। বর্তমানে ইজরায়েল প্রায় ৫০লক্ষ মানুষজনকে ভ্যাক্সিন দিতে সক্ষম হয়েছে, যা দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ শতাংশ। বৈজ্ঞানিকরা মতামত দিয়েছেন যে এখনও কিন্তু ইজরায়েল সামগ্রিক ভাবে হার্ড ইমিউনিটি লাভ করে উঠতে পারেনি। ক্রমশ ভ্যাক্সিন দেওয়া আরও বাড়ানো হলে এবং যথেষ্ট পরিমাণে সাধারণ মানুষ ভ্যাক্সিনের উভয় ডোজ নিলে, তবেই হার্ড ইমিউনিটির কথা চিন্তা করা শ্রেয় বলে তাদের অভিমত।
কী কী কারণে ইজরায়েল এই অবস্থায় পৌঁছতে পেরেছে
মনে করা হচ্ছে ইজরায়েলের কম জনসংখ্যা (মাত্র ১ কোটির আশেপাশে যেখানে ভারতবর্ষের বর্তমান জনসংখ্যা ১৩০ কোটির উর্দ্ধে) এবং উন্নত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ভ্যাক্সিন দেওয়ার উদ্যোগকে দ্রুত করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এবং ফাইজার কোম্পানির সঙ্গে ইজরায়েল সরকার কিছু নির্দিষ্ট চুক্তি স্থাপন করেন, যার মাধ্যমে ইজরায়েল প্রচুর পরিমাণে ভ্যাক্সিন লাভ করে, বদলে ফাইজারকে দিতে হয় ভ্যাক্সিনেশন এবং পোস্ট ভ্যাক্সিনেশন ফেজের মেডিক্যাল ডাটা। তার সাথে আরেকটি কারণ হচ্ছে মহামারীর শুরুর দিক থেকেই ইজরায়েল দেশে লকডাউন ঘোষণা করেছিল এবং এর ফলে কোভিড ১৯ এর সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়ান্ট ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। ইউরোপ বা আমেরিকা কিন্তু এই আঙ্গিকে এতটা সফল হতে পারেনি।
ভারতবর্ষ কি ইজরায়েল মডেল অনুসরণ করবে
প্রশ্ন উঠতেই পারে ইজরায়েলের সাফল্য দেখে যে দ্বিতীয় ওয়েভে জর্জরিত ভারতবর্ষ কি ইজরায়েলের মডেল অনুসরণ করবে? এক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করছে ভারতবর্ষের বিশাল জনসংখ্যা। বর্তমানে দিনে ৩৩ লাখ মানুষ টিকাগ্রহণ করলেও পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮.৫ % এখনও অবধি টিকার প্রথম ডোজটি গ্রহণ করেছেন। তাছাড়াও রয়েছে ভারতবর্ষের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা কোভিড-১৯ এর স্থানীয় স্ট্রেন। আপাতত দেখার, ভারতবর্ষের করোনাসঙ্কট কোন দিকে নতুন মোড় নেয়।