ভারতবর্ষের বৈচিত্র এবং সেই বৈচিত্রের মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষমতা পৃথিবী বিখ্যাত। ঠিক তেমনই ভারতবর্ষের ২৯টি রাজ্যের খাদ্যাভ্যাস কিন্তু ভীষণই আলাদা, যা নির্ভর করে জায়গাগুলির আবহাওয়া, কৃষি বা সংস্কৃতির উপর। অথচ খাদ্যরসিক রা কিন্তু পছন্দ করেন এই বৈচিত্রের সবকিছুই উদরস্থ করতে। তাই এভাবেই আমরা পেয়ে যাই বৈচিত্রের মধ্যেই সমন্বয়। তাই চলুন, দেখে নেওয়া যায় ভারতবর্ষের ২৯টি রাজ্যের ২৯টি বিখ্যাত ডিশ বা পদ, যা খাদ্যরসিকদের অবশ্যই চেখে দেখা উচিত।
অন্ধ্রপ্রদেশ : উপিন্ডি
উপিন্ডি যা একধরনের রাভা উপমা, অন্ধ্রপ্রদেশের এক জনপ্রিয় পদ। এটির আরিসি উপমা নামেও পরিচিত। খুব কম সময়েই তৈরি হয়ে যায় বলে এটি বেশ জনপ্রিয়।
অরুণাচল প্রদেশ : পেহাক
ফার্মেন্টেড সোয়াবিন এবং নাগা কিং চিলি নামক একধরনের খুব ঝাল লঙ্কা দিয়ে তৈরি হয় এই চাটনি বা আচার জাতীয় পদটি। ঝাল খাওয়ার অভ্যাস না থাকলে এটি এড়িয়ে যাওয়াই ভাল।
আসাম : বেঙ্গানা পিতিকা
সেদ্ধ আলু, আর ঝলসানো বেগুন একসঙ্গে নিয়ে তাতে মেশানো হয় সর্ষের তেল, ঝাল ঝাল লঙ্কা কুঁচি আর পেয়াঁজ কুঁচি। অনেকটা বাঙালি বেগুন ভর্তার মতো, কিন্তু আরও সহজ সরল। আসামে বিভিন্ন রকম পিতিকা খাবার সঙ্গে থাকতেই হবে।
বিহার : আহুনা বা চম্পারণ মাটন
বিহারের চম্পারণ জেলা হতে এই বিশেষ মাটন ডিশটির উৎপত্তি। পরিচিত আহুনা বা হান্ডি মাটন নামেও। সমস্ত উপকরণ একটি মাটির হাঁড়িতে শুকিয়ে ঢিমে আঁচে বহুক্ষণ ধরে রান্না করা হয়। লিত্তি চোখাকে একপাশে রেখে এখন এটাই বিহারের বিখ্যাত ডিশ...
ছত্তিশগঢ় : ডুবকি কাডি
এই পদে প্রথমে নানা রকমের ডাল ব্যবহার করে তৈরি করা হয় একধরণের পকোড়া। তারপর সেই পকোড়া রান্না করা হয় দই এবং নানান মশলা সহযোগে। পদটি শুধু জনপ্রিয় নয়, যথেষ্ট পুষ্টিকরও।
গোয়া : পর্ক ভিন্দালু
গোয়ার খাদ্যাভ্যাসে রয়েছে পর্তুগিজদের প্রচ্ছন্ন প্রভাব। আর সেই প্রভাব সুষ্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে জাকুটি, কাফরিয়াল, সর্পোটেলের মতো পদে। তবে গোয়ার সবথেকে বিখ্যাত এবং সুস্বাদু ডিশ হল অকৃত্রিম পর্ক ভিন্দালু।
গুজরাট : খন্ডভি
শুনতে একটু খটোমটো হলেও ফাফরা, খাকরার রাজ্যে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে কিন্তু খন্ডভি। এটি পাটুলি বা দহিভাদি নামেও পরিচিত। চা-এর সঙ্গে টা হিসাবে খন্ডভি কিন্তু বেশ।
হরিয়ানা : কৈর সাংগরী কি সবজি
উৎস রাজস্থানের রান্নাঘরে হলেও, হরিয়ানার অন্যতম জনপ্রিয় পদের নাম কৈর সাংগরী কি সবজি যা তৈরি হয় নানা রকম বিন, বেরি এবং বিভিন্ন রকম মশলা দিয়ে। খেতে পারেন ডাল-এর পরোটা দিয়ে।
ঝাড়খণ্ড : ধুসকা
ডালগুঁড়ো এবং চাল দিয়ে তৈরি একরকম খাবার, যা ঝাড়খণ্ডের ঘরে ঘরে একটি জনপ্রিয় প্রাতরাশের পদ। সঙ্গে নিয়ে নিতে পারেন একটু ঘুগনি বা ঝাল ঝাল মটরের তরকারি।
হিমাচলপ্রদেশ : চানা মাদ্রা
কাবুলিচানা দিয়ে তৈরি এই পদটির উৎপত্তি হিমাচলের চামাবা অঞ্চল থেকে। রাতভর কাবুলিচানা জলে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন বানানো হয় চানা মাদ্রা নামক এই টক ঝাল পদটি।
কর্ণাটক : নীর দোসা
মসলা দোসার সঙ্গে আমরা বহুল পরিচিত। কিন্তু কর্ণাটকের বিখ্যাত নীর দোসা সম্পূর্ণ অন্য মাত্রার জিনিস। নীর অর্থে জল বোঝানো হয়। জল দিয়ে পাতলা ব্যাটার দিয়ে তৈরি তুলতুলে এই দোসা খেতে পারেন একটু মাটন সুক্কার সঙ্গে।
কেরালা : পুত্তু
পুত্তু হল একধরণের কুড়ানো নারকুল দিয়ে ভাপা চালের তৈরি কেক, যা আকারে অনেকটা পাইপের মতো দেখতে। সঙ্গে থাকে কাদালা তরকারি নামক নারকোল দুধে তৈরি মটরের তরকারি।
মধ্যপ্রদেশ : ভুট্টা কি কিশ
মধ্যপ্রদেশের একটি অত্যন্ত ঘরোয়া পদ হল এই ভুট্টা কি কিশ নামক পদটি। ভুট্টার দানা গ্রেট করে তা রান্না করা হয় মশলা এবং দুধ দিয়ে, নামানোর আগে দেওয়া হয় সর্ষে, আর কাঁচা লঙ্কা।
মহারাষ্ট্র : পুরান পোলি
পুরান পোলি হল একধরনের মিষ্টি রুটি, যার ভিতরে থাকে চানা, নারকোল কুঁচি, গুড় বা আখের রস দিয়ে। উৎসবের সময় বা অনুষ্ঠান বাড়িতে পুরান পোলি দেখতে পাওয়া যায় বেশি করে।
মণিপুর : চামথং বা কাংশই
এটি একধরনের নিরামিষ স্টু বা স্যুপ জাতীয় ডিশ যা তৈরি হয় মরসুমের টাটকা সেরা সবজি দিয়ে, সঙ্গে থাকে পেয়াঁজ, লবঙ্গ, রসুন, আদা এবং মারোই। খাওয়া হয় ভাতের সঙ্গে।
মেঘালয় : জাদোহ
মেঘালয়ের খাসি জনগোষ্ঠীর মানুষজনের রন্ধনশৈলী অনুসরণ করলে খোঁজ পাওয়া যায় এই প্রাচীন প্রণালীটির। শূকর মাংস, ভাত, মশলা, মাছের টুকরো আর নানান সবজি দিয়ে তৈরি হয় এই পদটি।
মিজোরাম : মিজো ভাকসা
নর্থ ইস্টের বিভিন্ন পদে দেখা যায় পর্কের আধিপত্য। পর্ক মাংস স্মোক করে নতুন পালং শাক আর ওয়েস্টার মাশরুম দিয়ে তৈরি হয় এই ঘরোয়া পদটি। খাওয়া হয় স্টিকি রাইসের সঙ্গে।
নাগাল্যান্ড : বাঁশ-মাছ
নাগা জনজাতির খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে দেখা যায় বাম্বু স্টেম বা বাঁশ গাছের ফাঁপা অংশ ব্যবহার করে রান্না করার উদাহরণ। বাঁশের মধ্যে মশলা মাখানো মাছ ভরে, আগুনের ওপরে সরাসরি রোস্ট করা হয়। পোড়া পোড়া স্বাদের এই পদের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ছে গোটা ভারতবর্ষে।
ওড়িশা : সানতুলা
গ্রামীণ ওড়িশা এক সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর পদ এটি। তৈরি করা হয় কাঁচা পেঁপে, বেগুন, টমেটো এবং অল্প একটু মশলা দিয়ে। বিভিন্ন রোগ উপশমের জন্যে এই পদটি পথ্য হিসাবেও ব্যবহৃত হয়।
পাঞ্জাব : অমৃত্সরি মছলি
পাঞ্জাবের অমৃত্সরের অন্যতম জনপ্রিয় একটি পদ হল এটি, যা স্বাদে গন্ধে একবারের স্বতন্ত্র এবং ক্রমশ জনপ্রিয় লাভ করছে। এছাড়াও আছে সরসো দি সাগ, চিকেন তন্দুরি, ছোলে বাটুরে প্রভৃতি।
রাজস্থান : লাল মাস
যদিও রাজস্থানে নিরামিষভোজী মানুষের সংখ্যা বেশি, তাও এই রাজ্য থেকেই আমরা পেয়েছি লাল মাসের মতো একটি অত্যন্ত সুস্বাদু এবং বিখ্যাত পদ। এছাড়াও খেয়ে দেখতে পারেন ডাল বাটি চুরমা আর ঘেওয়ার।
সিকিম : ছুরপি
আমরা নানান বিদেশি চিজ খেয়ে থাকলেও দিশি চিজের ব্যাপারে কিন্তু বেশি খবর রাখি না। সিকিমের ছুরপি এরকম একটি চিজ, যা প্রয়োজন অনুসারে নরম বা শক্ত করে তৈরি করা হয়। নরম ছুরপির তরকারি সিকিমের অন্যতম প্রিয় পদ।
তামিলনাড়ু : প্ৰন কুজাম্বু
তামিলনাড়ুর কুইজিনের বিভিন্ন পদ প্রচন্ড বিখ্যাত এবং রসম, উত্তাপম, দোসা ইত্যাদি সারা দেশ তথা পৃথিবী জুড়ে জনপ্রিয়। এরই মধ্যে একটি অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয়, কিন্তু অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু পদ হল প্ৰন কুজাম্বু।
তেলেঙ্গানা : হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি
অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে তেলেঙ্গানার স্বতন্ত্র পরিচয় বজায় রাখতে সাহায্য করেছে এখানকার রন্ধনশৈলী। হায়দ্রাবাদি ঘরানার বিখ্যাত বিরিয়ানি, সে কাচ্চি হোক বা পাক্কি, স্বাদে গন্ধে কলকাতা বিরিয়ানির থেকে অনেকটাই আলাদা, কিন্তু কোনও অংশে কম নয়!
ত্রিপুরা : মুই বরোক
ত্রিপুরার খাবারে দেখা যায় বাঙালি, নর্থ ইস্ট এবং মায়ানমারের রন্ধনশৈলীর প্রভাব। ভারতবর্ষের বিভিন্ন কুইজিনের মধ্যে ত্রিপুরার কুইজিন এখনও সেরকম জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। খেয়ে দেখতে পারেন মুই বরোক, তেল ছাড়া একরকম নোনতা এবং ঝাল ঝাল মাছের পদ হল এটি...
উত্তর প্রদেশ : কাকোরি কাবাব
উত্তরপ্রদেশের খাবার কথা বলতে গেলে মনে করতেই হবে নবাবী ঐতিহ্যশালী লখনউয়ের কথা। অল্প মশলা, ভেড়া বা ছাগলের মাংস দিয়ে তৈরি লখনউয়ের কাকোরি অঞ্চলে সৃষ্ট এই কাবাব বর্তমানে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে।
উত্তরাখণ্ড : ভাঙ কি চাটনি
পাহাড়ি উত্তরাখণ্ডের কুইজিনে দেখা যায় স্থানীয় শাক সবজির আধিক্য। এমনই একটি পদ হল ভাঙ কি চাটনি যা প্রকৃতপক্ষেই ভাঙ, জিরে, লেবু, তেঁতুল আর লাল লঙ্কা দিয়ে। ভিটামিন সি-এর অভাব থাকলে এই চাটনি খুব তাড়াতাড়ি স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম।
পশ্চিমবঙ্গ : লুচি দিয়ে কষা মাংস
পদে পদে আমাদের ভারতবর্ষের অবসান ঘটুক আমাদের মাতৃভূমি পশ্চিমবঙ্গের পাতে। হাজার হাজার পদের মধ্যে থেকে যে কোনো একটি বেছে নেওয়া খুবই দুরূহ, তবে আশা করা যায় লুচি আর কষা মাংসের স্বর্গতুল্য যুগলবন্দি প্রতিটি বাঙালির স্বাদকোরকে আনে খুশির জোয়ার।