
সংস্কৃত সত্তিকা শব্দের অর্থ হল কাপড়ের টুকরো বা শাড়ি। অনার্য সভ্যতায় শটী শব্দের অর্থ ছিল পরিধানের বস্ত্র। ঐতিহাসিক যুগ থেকেই শাড়ির ব্যবহার কিন্তু হয়ে আসছে নানা রকমভাবে। শুধু শাড়ির নামই নয়, বিভিন্ন অঞ্চলভেদে শাড়ির পরিধান শৈলীও কিন্তু এক এক রকমের হয়। পুরাকালে মানুষ এক ধরণের শাড়ি পরিধান করতেন। বর্তমানে কিন্তু নারীদের অন্যরকম শাড়ি পরিধান করতে দেখা যায়। তবে আধুনিককালে মূলত ঠাকুর পরিবারের সদস্য সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর হাত ধরে শাড়ি পরার আঙ্গিক পরিবর্তিত হতে থাকে।
‘বন্যেরা বনে সুন্দর’ আর শাড়ি সুন্দর নারীর অঙ্গে। তাই সেই সৌন্দর্যতার রহস্য উন্মোচন করতে আজ আমরা কথা বলব শাড়ির রানী তামিলনাড়ুর কাঞ্জিভরমকে নিয়ে। কোথা থেকে এল এই কাঞ্জিভরম? কেনই বা অন্যান্য শাড়ির তুলনায় এই শাড়ি এত বেশি মূল্যবান এবং প্রত্যেকটি নারীর কাছে সেটি অহংকারের? আজ সেইসব কিছুই আমরা জেনে নেব।
কাঞ্জিভরম শাড়ির ইতিহাস:
ভারতবর্ষের তামিলনাড়ু রাজ্যের কাঞ্চিপুরম অঞ্চলে মূলত এই ধরনের শাড়ির বুনন প্রক্রিয়া দেখতে পাওয়া যায়। মনে করা হয় রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সময় থেকে এই শাড়ি নিজের গরিমায় গৌরবান্বিত হয়ে ওঠে। হিন্দু পৌরাণিক কথা অনুযায়ী, কাঞ্জিভরম শাড়ি তৈরির বুনন শিল্পীদের মহর্ষি মারকাণ্ডে বংশধর হিসেবে ধরা হয়। সেই জন্য হিন্দু পুরাণেও কাঞ্জিভরম শাড়ির উল্লেখ রয়েছে।
তামিলনাড়ুর শীতল স্থানগুলিতে প্রথমে রেশমের উৎপাদন করা হয়। এরপর সেগুলিকে সঠিক মাত্রায় প্রক্রিয়াশীল করে তোলার জন্য ব্যাঙ্গালোরে পাঠানো হয়। তারপর সেখান থেকে আবার তামিলনাড়ুতে ফিরিয়ে এনে সুতোগুলিকে শাড়ির বুনন অনুযায়ী রঙ করা হয়। মোটামুটিভাবে ১ কেজ ( তামিলনাড়ু স্থানীয় হিসাব ) রেশম সুতোর দাম পরে ৪৫০০ টাকা, যা দিয়ে মোটামুটিভাবে ৩ টি কাঞ্জিভরম শাড়ি বোনা যায়। তামিলনাড়ুতে সোনার জরির কাজের কাঞ্জিভরম খুব বিখ্যাত। আর এই জরি আসে সুদূর সুরাট থেকে। এই শাড়ি হাতে বোনা হয়। তাই এই পদ্ধতিকে করভাই পদ্ধতি বলে। এই পদ্ধতিতে বোনা শাড়ির পাড় এবং আঁচলের রং এক হয়। এক একটি কাঞ্জিভরম শাড়ি তৈরি করতে প্রায় ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে। আর প্রতিদিন তাঁতিরা প্রায় ৮ ঘণ্টা করে কাজ করেন।
কাঞ্জিভরম শাড়ির বৈশিষ্ট্য:

• এই শাড়িকে শাড়ির রানী বলা হয় প্রধানত এর রং ও অসাধারন নকশার জন্য।
• কাঞ্জিভারাম সিল্কের ওপর বেনারসির কাজ দক্ষিণ ভারতীয় শাড়ির এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
• এই শাড়ির পাড় খুব ভারী হয়।
• গুণগতমানের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য এই শাড়ি বুননের সময় মলবড়ি সিল্ক ব্যবহার করা।
• সাধারণ সিল্কের শাড়ি ৪৬ ইঞ্চি দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু কাঞ্জিভরম শাড়ি ৪৮ ইঞ্চি হয়।
• এই শাড়িতে বিভিন্ন রকমের নকশা যেমন- সূর্য, চন্দ্র, ময়ূর, হংস, রথ, তামিলনাড়ু বিভিন্ন মন্দিরের দেওয়াল চিত্র ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়।
কাঞ্জিভরম শাড়ির দাম:
সাধারণত কাঞ্জিভরম শাড়ি অন্যান্য সিল্ক শাড়ির তুলনায় একটু দামি হয়। তবে স্বর্ণপাড় বিশিষ্ট শাড়িগুলোর দাম প্রায় ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ পর্যন্ত চলে যায়। কোথাও কোথাও এর থেকেও বেশি হয়।
কাঞ্জিভরম শাড়ির যত্ন:
• কাঞ্জিভরম শাড়ি সাধারণত বাড়িতে পরিষ্কার করা উচিত নয়। এক্ষেত্রে বড় কোনও ভাল দোকান থেকে তা কাচিয়ে রাখাই শ্রেয়।
• অবশ্যই ঠান্ডা জলে ধোয়া উচিত।
• ক্ষারবিহীন সার্ফ দিয়ে কাপড় কাচা প্রয়োজন।
• কাচার পরে শাড়ি নিংড়ানো উচিত নয়।
• ধোয়ার পর শাড়ি অবশ্যই ছায়ায় মেলে রাখতে হবে কারণ সূর্যের রশ্মি এই শাড়ির ক্ষতি করে।
• একদম হালকা তাপমাত্রায় এই শাড়িটিকে ইস্ত্রি করতে হয়।
• প্লাস্টিক প্যাকেট এই শাড়ি রাখা উচিত নয়।
• এই শাড়ির কাজ খুব ভারী হয় বলে হ্যাঙ্গারে বা কোথাও না ঝুলিয়ে আলগা করে ভাঁজ করে রাখাই উচিত।
• যে বাক্সে শাড়িটি রাখা হবে, সেই বাক্সে ন্যাপথলিনের পরিবর্তে দারুচিনি বা লবঙ্গ রেখে দেওয়া দরকার, যাতে পোকা-মাকড় থেকে শাড়িটিকে সংরক্ষণ করা যায়।
• একভাবে এই শাড়ি বেশিদিন রেখে দিলে জরির সুতোগুলি ছিঁড়তে শুরু করে। তাই বছরে অন্তত দু’বার শাড়ি খুলে অন্যরকমভাবে ভাঁজ করে রাখা উচিত।
তবে বর্তমানে কাঞ্জিভরম শাড়ির আভিজাত্য বজায় থাকলেও তামিলনাড়ুতে এই শাড়ি বুননকারী তাঁতিদের অভাব দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ তাঁতিরা এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যোগদান দিয়েছেন। কারণ শাড়ি বুনন করে এক মাসে যে অর্থ তারা সংগ্রহ করেন, তাতে তাদের সংসার চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পরে। তাই তাঁতির ঘরের ছেলেমেয়েরা আজ আর কেউ এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে নারাজ।