‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দ কেনে’ গানটির সঙ্গে সবাই কম বেশি পরিচিত। তাই এই গানের গীতিকারের সঙ্গে আর আলাদা করে পরিচয় করানোর মতো অবকাশ রাখে না। তবে গানের থেকেও বেশি কথাসাহিত্যিক হিসেবে বাঙালির কাছে পরিচিতি পেয়েছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু সাহিত্যিক নন, ‘ইতিহাস ও সাহিত্য’ প্রবন্ধে তিনি এক জায়গায় বলেছেন “অভিনয় ভালো লাগে, নাটক রচনা করি।”
সর্বগুণসম্পন্ন এই মানুষটির যে শুধু সাহিত্যিক মহলে নয় আর পাঁচটা জনসাধারণের সঙ্গেও নিবিড় সম্পর্ক ছিল তা বোঝা যায় তাঁর লেখনীর মধ্যে দিয়ে। তাঁর লেখনীতে ধরা পড়েছে সাঁওতাল, বাগদি, বাউরি, বোষ্টম, ডোম প্রভৃতি সম্প্রদায়ের কথা। ফুটিয়ে তুলেছেন সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন চিত্র, গ্রাম্য জীবনের কথা, নগর জীবন বিকাশের কথা। শুধু তাই নয় ‘গণদেবতা’, ‘কালিন্দী’, ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘অভিযান’, ‘পদচিহ্ন’, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’-র মতো উপন্যাস সৃষ্টি করে তিনি বাংলা সাহিত্যেকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। আর এই সমস্ত লেখনীর জন্য তিনি জ্ঞানপীঠ, পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, রবীন্দ্র পুরস্কারের মতো বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
সাহিত্যিকের জন্মভিটে লাভপুরের পরিচয় বৃত্তান্ত:
ময়ূরাক্ষী নদীর অববাহিকায় অবস্থিত বন্যাপ্রবণ একটি প্রত্যন্ত গ্রাম হল লাভপুর। কিন্তু এই লাভপুর জনপ্রিয়তা লাভ করেছে কিন্তু অন্য কারণে। ১৮৯৮ সালে ২৩শে জুলাই প্রখ্যাত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন এই গ্রামে। গ্রামটি ছিল সাহিত্যিকের সাহিত্যচর্চার অন্যতম পীঠস্থান। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’-য় রয়েছে এই লাভপুরবাসীর সুখ-দুঃখের কথা। রয়েছে কোপাই নদী।
চারিদিক শান্ত নির্জন চিরহরিৎ বৃক্ষের সমারোহে গড়ে ওঠা এই লাভপুর গ্রামটির প্রাকৃতিক শোভা অত্যন্ত মনোরম। এখানে রয়েছে সাহিত্যিকের বাড়ি। ১৯৩০ সালে ২৬শে জানুয়ারি লাভপুরের মাটিতে দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৬৫ সালে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়ে গেলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাগে পড়ে এই বাড়ির কাছারি বাড়ির অংশটি। এই কাছারি বাড়িতে বসেই তিনি জীবনের বেশ অনেকটা সময় সাহিত্য রচনা করেছেন। চলেছে বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডা। তবে এই কাছারি বাড়িটি পরবর্তীতে ধাত্রীদেবতা নামে পরিচিতি পেয়েছে। প্রায় ২৪০০ বর্গফুটের তৈরি জীর্ণ ফাটল ধরা এই বাড়িটি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহু স্মৃতি বহন করে।
তবে ২০১৮ সালে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন প্রায় সাড়ে ৩০ লক্ষ টাকা দিয়ে এই বাড়িটির মেরামত করেছেন। বর্তমানে, যা বহু সাহিত্য প্রেমের কাছে হয়ে উঠেছে সাহিত্য সৃষ্টির এক আকর্ষণীয় কেন্দ্রবিন্দু। এখানে একটি সংগ্রহশালা রয়েছে, যেখানে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন ছবি, তাঁর ব্যবহৃত কলম, চেয়ার, বিভিন্ন স্থাপত্য শিল্প, তাঁর নিজের হাতে আঁকা ছবি, ঘড়ি, পাণ্ডুলিপি, পদক, কাটুম কুটুম ইত্যাদি দেখার জন্য বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন ছুটে আসেন। এই সংগ্রহশালাটির বর্তমান দায়িত্বে রয়েছে বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৌত্র অমলশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
পথনির্দেশ:
কলকাতা থেকে আমোদপুর স্টেশনে নেমে লাভপুরে পৌঁছনো যায়।
লাভপুরের দর্শনীয় স্থান:
৫১ সতীপীঠের ৪৯তম পীঠ ফুল্লরা মন্দির এখানে অবস্থিত।