প্রতি বছর রমজানের সময় কিন্তু খাদ্যপ্রেমীকরা একটু বেশিই উৎসাহী হয়ে পড়েন। কারণ ? এমন একটি জিভে জল আনা খাবার, যা বছরের অন্যান্য সময়ে থাকে আমাদের কাছে অধরা। শুধুমাত্র রমজানের সময়ে সারাদিন রোজা পালনের কষ্ট লাঘব করতেই হয়তো ধরিত্রীর বুকে হালিমের আগমন। আসুন, জেনে নেওয়া যাক হালিমের খুঁটিনাটি।
হালিম আসলে ঠিক কী
হালিম বিভিন্ন রকম ডাল এবং মাংস দিয়ে তৈরি এক ধরনের ঘন এবং অত্যন্ত উপাদেয় স্টু জাতীয় খাবার, যা প্রোটিন-প্রধান এবং অত্যন্ত পুষ্টিদায়ক কিন্তু একই সঙ্গে বেশ সহজপাচ্যও। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, মধ্য এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে হালিমের রমরমা দেখা যায়। টার্কি, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারতবর্ষ বা বাংলাদেশে অঞ্চল বিশেষে হালিমের প্রকারভেদ দেখা যায়। উল্লেখযোগ্য, ভারতবর্ষে কলকাতা এবং হায়দ্রাবাদের হালীম আলাদা আলাদা ভাবে নিজ গুণে এবং স্বাদে রূপে স্বতন্ত্র এবং খাদ্যরসিকদের একান্ত প্রিয়।
হালিমের গুণ রয়েছে হালিমের প্রস্তুতিতে
ভালো হালিমের জন্যে লাগে কিন্তু অল্প কয়েকটি উপকরণ - বিভিন্ন রকমের ডাল, সঙ্গে অল্প গম বা যব, ল্যাম্ব বা মটন (যদিও বর্তমানে চিকেন হালিমও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে), বিভিন্ন রকম মশলা, আর জল, ব্যাস। তবে কিছু পুরনো রেসিপিতে জলের বদলে খাঁটি দুধ ব্যবহার করা হয়।
হালিম কিন্তু রান্না করা হয় সব উপকরণ একসঙ্গে দিয়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঢিমে আঁচের ওপরে। প্রধান রাঁধুনির দায়িত্ব থাকে সব সময় হালিমের মিশ্রণটি নাড়িয়ে যাওয়ার। এর ফলে হালিমের সমস্ত উপকরণ ভালো করে মিশে গিয়ে একধরনের ঘন মিশ্রণে পরিণত হয়, যেখানে প্রতি চামচেই আপনি পাবেন একসঙ্গে সবরকম উপকরণ খাওয়ার আনন্দ। হালিম তৈরি হতে সময় লাগে কম করেও ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা। পরিবেশন করা হয় উপরে বেরেস্তা, লঙ্কা কুঁচি, আদা কুঁচি, ধনে পাতা এবং একটুকরো লেবু দিয়ে।
ইতিহাসে হালিম
হালিমের উৎপত্তি হারিস বা জারিষ নামক এক আরব খাবার থেকে, যার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১০ম খ্রিস্টাব্দে। বিভিন্ন দেশ ঘুরে আসতে আসতে তা ভারতে প্রবেশ করে হায়দ্রাবাদের নিজামের সাম্রাজ্যের আরবী সৈন্যদের হাত ধরে। এই হারিস বা জারিষ আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হতে থাকে এবং ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাদকোরকে স্থায়ী জায়গা করে নেয়, পরিচিত হয় হালিম নামে, যা ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হায়দ্রাবাদী এবং কলকাতার হালিমের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক, দুই অঞ্চলের বিরিয়ানির মতোই। হায়দ্রাবাদী হালিম অনেক বেশি থকথকে এবং মিশ্রণটি অনেক বেশী ঘন, ডাল এবং মাংসের টুকরো একেবারে মিশে যায় এবং আলাদা করা যায় না। কলকাতার হালিম অনেকটা ঘন স্যুপের মতো, যেখানে ঘন ডালের মাঝে মাঝে সুস্বাদু ছোট্ট ছোট্ট মাংসের টুকরো খুঁজে পাওয়া যায়। স্বাদের দিকেও আছে বেশ কিছুটা তারতম্য।
কলকাতার কোথায় সুস্বাদু হালিম পাবেন
আমিনিয়া, জাকারিয়া স্ট্রিট - জাকারিয়া স্ট্রিটের মূল আমিনিয়ার সবথেকে পুরনো শাখার হালিম বেশ বিখ্যাত এবং উপাদেয়। এখানকার বিফ হালিম সবথেকে বিখ্যাত, যার রেসিপিটির বয়স ১০০ বছরের কাছাকাছি।
সিরাজ গোল্ডেন রেস্টুরেন্ট, পার্ক স্ট্রিট - এখানে পাবেন বিখ্যাত আফগান হালিম যা তৈরি করা হয় মটন কিমা আর কোফতা ব্যবহার করে।
এছাড়াও আরসালান, বড়বাজারের রয়্যাল, খিদিরপুরের ইন্ডিয়া রেস্টুরেন্ট, জিশানের হালিম ও বেশ জনপ্রিয় এবং নিমেষে ফুরিয়ে যায়। আর যদি মন চায় হায়দ্রাবাদের হালিমের স্বাদ গ্রহণ করতে তাহলে যোগাযোগ করতে পারেন হায়দ্রাবাদের পিস্তা হাউস, শাদাব, শাহ ঘউস বা সার্ভি রেস্টুরেন্টের সঙ্গে। রমজানের সময়ে এই হায়দ্রাবাদী রেস্টুরেন্টগুলি সারা ভারতবর্ষে প্যাকেজ করা হালিম পাঠিয়ে থাকেন।
হালিম খেতে ইচ্ছে হলে কিন্তু বেশি রাত করা উচিত হবে না, কারণ সন্ধের পরে রোজা পালন সম্পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু প্রতিটি দোকানে উৎসাহী মানুষের ঢল নামে। তাই হালিম পাওয়া যাবে নিশ্চিত করতে চাইলে, শেষ বিকেলের দিকে পেট পুজো করাই সবথেকে শ্রেয়।