বোলপুর:
সপ্তাহান্তে দুই একদিন ছুটি পেলে আর পাঁচজনের মতো আমিও বেরিয়ে পরি ঘুরতে। তবে এবার আমার গন্তব্যস্থান ছিল শান্তিনিকেতন, যা বাঙালির অন্যতম প্রিয় জায়গা। হঠাৎ করেই তিন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম শান্তিনিকেতনে ঘুরতে যাব। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলাম এবার ওখানে গিয়ে কথাকথিত হোটেল বা রিসর্ট ছেড়ে আমরা থাকব আমখই গ্রামে এই আমখই গ্রামটি বিরল জীবাশ্ম পার্ক হিসাবে বিখ্যাত। ভারতে ঘুঘুয়া জীবাশ্ম পার্ক, মণ্ডলা জীবাশ্ম পার্ক, শিবালিক জীবাশ্ম পার্ক এবং তিরুভাক্কারাই জীবাশ্ম পার্ক ইত্যাদি কিছু বিখ্যাত জীবাশ্ম পার্ক রয়েছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় ইলামবাজার বনাঞ্চলের রয়েছে আমখই নামে বিখ্যাত একটি জীবাশ্ম পার্ক।
শান্তিনিকেতন গিয়ে আমরা ব্যাটারিচালিত রিকশা, যাকে ওখানকার ভাষায় টোটো বলে সেটি ভাড়া করলাম এবং ইলামবাজারের দিকে আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। জাতীয় সড়ক ধরে কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর ধল্লা নামে একটি জায়গার সন্ধিক্ষণে এসে আমরা পৌঁছলাম এবং সেখান থেকে বাঁ দিকে ঘুরতেই খুঁজে পেয়ে গেলাম মাটির তৈরি রাস্তা, যেটি বরাবর আমরা একটি বনের ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলাম। এখানে শাল, পিয়াল, সিসো, ইউক্যালিপটাস, আকাশমনি, নিম প্রভৃতি কাছের ঘন জঙ্গল। সেটির পাশ দিয়ে আমরা একটি চেকপোস্ট পেরিয়ে আমাদের গন্তব্যস্থল আমখই জীবাশ্ম পার্কে পৌঁছলাম।
সেখানে পৌঁছে আমরা প্রথমে খুব অবাক হলাম এটা দেখে, যে জীবাশ্মরূপী বড় বড় গাছের কাণ্ডগুলি কীভাবে এদিক-ওদিক বিস্তার লাভ করেছে। শুধু তাই নয় এগুলির রং একেবারে লাল, যাএখানকার মাটির রংকে ইঙ্গিত করে। তবে জায়গাটিতে এখনও উন্নয়নের কাজকর্ম চলছে। আর সেটি এখানকার গ্রামে স্থানীয় বাসিন্দারাই করে থাকেন। যেখানে
যেখানে ছোট সিমেন্টের প্ল্যাটফর্ম রয়েছে সেখানে বড় আকারের কিছু জীবাশ্মর নমুনা প্রদর্শন করা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় জীবাশ্মের টুকরো দিয়ে জায়গাটিকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে, যাতে বাইরে থেকে মানুষ এসে তা দেখে আনন্দ ভোগ করতে পারেন। এখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা তাদের মূল্যবান এইসব প্রাকৃতিক ধনসম্পত্তিগুলোকে সব সময় আগলে রেখেছেন এবং এখানে ঘুরতে আসা বিভিন্ন ভ্রমণকারীদের সেটি সম্বন্ধে কোনও জিজ্ঞাসা থাকলে তাতেও তারা সর্বদা সাহায্য করেন। এই সবকিছুর মাঝখানে একটি জলাশয় রয়েছে। এই জলাশয়ের ঠিক মাঝখানে আমরা একটি বড় গাছেরগুঁড়ির জীবাশ্ম দেখতে পেলাম।
বীরভূমের ইলামবাজারের প্রথম এই জীবাশ্ম পার্ক তৈরি হয়। পরবর্তীতে প্রায় ১০ হেক্টর জমির উপর বন-বিভাগের তরফ থেকে আস্তে আস্তে এই আমখই আর জামবনি নামের দুটি জীবাশ্ম পার্ক তৈরি করে। বর্তমানে ১০টি স্বনির্ভর গোষ্ঠী এখানে এসে স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তায় তাদের কাজ করতে শুরু করে। বহু বছর ধরে এই জায়গাটিতে অনেক জীবাশ্ম শিকারি এসে এগুলিকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং কিছু অমূল্য জিনিস চুরি করে নিয়ে যায়। তারা সেগুলিকে সংগ্রহ করে বেশ চড়া দামে বাজারে এবং অনলাইনেও সেগুলি বিক্রি করে। এইভাবে একদিন এখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা সেটি বুঝতে পারে এবং তারা নিজেরা নিজেদেরকেই এই অমূল্য জিনিসগুলির সংরক্ষণ করার কাজে নিযুক্ত করেন।
ইলামবাজার:-
ইলামবাজার বনাঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত আমখোই খুব ছোট্ট একটি গ্রাম। একদিন জলাশয় খননকার্যের সময় কিছু অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কৃত হয়। সেগুলি দেখে এখানকার উপজাতিরা সেই কথা সঙ্গে সঙ্গে বনদপ্তরের কর্মকর্তাকে জানান। এরপর তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য ভূতত্ত্ববিদদের শান্তিনিকেতনে ডেকে আনেন। তারপর তারা জানান এটি প্রায় ১ মিলিয়ন বছর পূর্বের একটি জীবাশ্ম বনভূমি। আর এরপর থেকেই এই স্থানটি ভূতত্ত্ববিদদের কাছে হয়ে ওঠে ক্ষুদ্র ধনসম্পত্তি পরিপূর্ণ বাক্সের মতো। পূর্বে বর্ধমানের আউসগ্রাম, বাঁকুড়ার সোনামুখী, মেদিনীপুরের গড়বেতা, উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ-এর মুরাবালা নদীর তীর থেকেই সব জীবাশ্ম অংশগুলিকে আবিষ্কার করা হয়েছিল। কিন্তু এত বড় প্রান্তর জুড়ে জীবাশ্ম শুধুমাত্র আমখইতেই দেখতে পাওয়া যায়।
এরপর একের পর এক পুকুর খনন করে জীবাশ্মরূপী বড় বড় গাছের কাণ্ডগুলিকে আবিষ্কার করার কাজ চলতে থাকে। ভূতাত্ত্বিকেরা এখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে লখনৌর বীরবল সাহানি ইনস্টিটিউটে পাঠান; এবং পরবর্তীতে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা জানান যে এখানে পাওয়া জীবাশ্মগুলি প্রায় ১৫ মিলিয়ন বছরের পুরনো।
বীরভূম জেলার ইলামবাজার বনাঞ্চলে অবস্থিত আমখোই গ্রামে পুকুর কেটে এক অদ্ভুত কাঠের জীবাশ্ম পাওয়া যায়, যার নাম অ্যানজিওস্পার্ম। যেগুলি দেখে বোঝা যায় একসময় এখানে বিশাল চিরসবুজ বৃক্ষের বনভূমি ছিল, প্রায় পনেরো থেকে কুড়ি মিলিয়ন বছর আগে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা যেমন- বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুরে এই কাঠের জীবাশ্ম দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও ওড়িশা জেলায় ময়ূরভঞ্জতে দেখতে পাওয়া যায়।
বিজ্ঞানীদের দ্বারা পশ্চিমবঙ্গ সরকার বেশ কিছু পুরনো অরণ্য পরিবারকে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হল- ডিপ্তেরক্যাপাসে, আনার্ডিয়াসে, কম্বারেতাসে এবং লাগুমিনোস প্রভৃতি। তবে বর্তমানে এর মধ্যে কিছু কিছু জেনার আজও এখানে রয়েছে। তবে জেনার সম্প্রদায় আজ প্রায় অবলুপ্তির পথে। তাদেরকে এখন পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, মায়ানমার এবং মালয়েশিয়ায় দেখতে পাওয়া যায় ।
অতীতে এই জায়গাটিতে উত্তর-পশ্চিম বীরভূমের রাজমহল পাহাড় এবং ছোটনাগপুর মালভূমি অবস্থান করত। অনুমান করা হয়, উত্তর-পশ্চিমে নদীগুলির বন্যা জল যখন দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর প্রতিটি জেলার উপর দিয়ে বয়ে যেত তখন এখানকার গাছগুলোর এই অংশবিশেষ সেখানকার মাটি এবং বালির সঙ্গে মিশে এই কাঠের জীবাশ্ম তৈরি করেছে। ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার অপর দু'ধরনের পেট্রিফাইড কাঠ খুঁজে পাওয়া গেছে। বনদপ্তর থেকে একটি প্রচেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে এখানকার মানুষজনকে এই সমস্ত দুষ্প্রাপ্য জীবাশ্ম সম্বন্ধে একটু জ্ঞান প্রদান করা যায়। তাতে অন্তত তারা বুঝতে পারে, যে এগুলি আমাদের রাজ্যের এক ঐতিহ্যপূর্ণ সম্পদ।
এবারের ঘুরতে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা আমাদের একদম নতুন এবং ভিন্ন ছিল। নতুন নতুন ক্ষুদ্র জিনিস আবিষ্কার এরপর আমরা আবার পুনরায় সন্ধ্যাবেলা শান্তিনিকেতনে ফিরে আসি।
দারন্ডা:-
এখানে আসলে দেখতে আপনি দেখতে পাবেন এখানকার একজন স্থানীয় মহিলা কীভাবে একটি ছোট্ট ক্যাফেটেরিয়া চালাচ্ছেন এবং একইসঙ্গে কিছু জিনিসপত্রের দোকান সাজিয়ে নিয়ে বসেছে। তবে এখানকার মিউজিয়ামটি এখনও নির্মাণাধীন। ২০১৭ সালের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এখানকার উদ্যোক্তাদের সঙ্গে একটি বৈঠক হয়, যেখানে ঠিক করা হয় এই আমখোই-এর জীবাশ্ম পার্কটিকে একটি ইকো ট্যুরিজম প্রকল্প হিসেবে কাজ করানো হবে এবং তার জন্য বিভিন্ন রকমের উদ্ভিদ এনে এই জায়গাটি সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলা হবে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। আপাতত যে পদক্ষেপগুলি নেওয়া হয়েছে-
• হরিণদের জন্য উদ্যান তৈরি।
• জলাশয়ে খনন করে জীবাশ্মের সন্ধান।
• জীবাশ্ম উদ্যানগুলিকে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলা।
• শিশুদের জন্য খেলার জায়গা এবং উদ্যান তৈরি করা।
• ল্যান্ডস্ক্যাপিং।
• এই সমস্ত জীবাশ্ম পার্কগুলির মধ্যে একটি পিকনিকের জায়গা তৈরি করা।