রাত পোহালেই সূর্য রশ্মি দিগন্তরেখা ছুঁলে, সূচনা হবে একটি নতুন দিনের। কালকের দিনটা কিন্তু আর পাঁচটা দিনের থেকে একটু আলাদা। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে, বাড়ির বড়দের আশীর্বাদ নিয়ে আমরা খাতায় ভুল করে ১৮২৭ কেটে লিখব ১৪২৮। আর সঙ্গে সঙ্গেই মেতে উঠব নতুন বছরকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে।
প্রতিবছর নববর্ষে প্রত্যেকের ভেতরে লুকিয়ে থাকার স্বপ্ন ইচ্ছাগুলো আবার যেন নতুন করে ডানা মেলতে শুরু করে। তাই নববর্ষ উদযাপন কীভাবে পালন করা হবে তা অনেকদিন আগে থেকেই ঠিক করে রাখা হয়। ঠিক সেই কারণেই শত বাধাবিপত্তি এবং করোনার মত অতিমারীকে কাটিয়ে উঠেও নববর্ষ উদযাপনের শুধু ভারতবর্ষে নয়, বাংলাদেশেও বেশ কিছু নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী, বাংলা ক্যালেন্ডারের ১৪২৮ সালকে স্বাগত জানানোর জন্য এই বছর তারা কিছু অনলাইন প্রতীকী কর্মসূচির ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করেছে। এই সমস্ত অনুষ্ঠানের শুভ আরম্ভ করা হয়েছে বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী আজ সকাল ৭টায়। অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন ছায়ানৌত।
প্রতিবছর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রমনা বাতামূলে ছায়ানৌত আয়োজিত কিছু বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯-এর কথা মাথায় রেখে আগের বছর এই অনুষ্ঠানটি বন্ধ রাখা হয়েছিল এবং এ বছর সেটি অনলাইনে পরিবেশন করা হয়। ছায়ানৌত-এর সম্পাদক লায়সা আহমেদ লিসা নিউ এজ আর্লিয়ার-কে তাঁর একটি বক্তব্যে জানিয়েছেন “এই বছর আমরা রমনা বাতামূল আয়োজিত অনুষ্ঠানটি কোনওভাবেই স্থগিত রাখব না। বাংলাদেশের টেলিভিশনে ঠিক সকাল ৭টায় সেটি সম্প্রচারিত হবে এবং তার সঙ্গে ইউটিউবেও সেটি দেখানো হবে।” ছায়ানৌত-এর সভাপতি সানজিদা খাতুন-এর মতে, এইবারের অনুষ্ঠানে বেশ কিছু পুরনো দিনের অনুষ্ঠানের স্মৃতি তুলে ধরা হবে। বিগত বছর কিছু পুরোনো গান এখানে পরিবেশন করা হবে। একটি ইন্ডোর ভেন্যুতে এখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে কিছু ভিডিও তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে তিনি জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত ফাইন আর্টস ডিপার্টমেন্টের সদস্যরা মিলে বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে একটি প্রতীকী মঙ্গল শোভাযাত্রা ব্যবস্থা করেছেন। ১৯৮৯ সালে থেকে প্রতিবছর ঢাকা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে থাকেন, যেখানে শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা নন, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন এসে এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। গত বছর করোনার মত অতিমারী পরিস্থিতির জন্য এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে স্থগিত রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই বছর এফএফএ-র কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মোটামুটি ১০০টি রঙীন ঐতিহ্যবাহী মুখোশ এবং কিছু আনুষ্ঠানিক প্রপস ব্যবহার করে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে।
কিছুদিন আগে থেকে জাইনুল গ্যালারিতে বেশ কিছু সংখ্যক শিক্ষক এবং ছাত্র ছাত্রীরা বিভিন্ন রকমের প্রপস এবং রঙিন থিমের মুখোশ তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। প্রতিবছর বাংলাদেশে নববর্ষ পালনের জন্য নির্দিষ্ট কিছু থিম ব্যবহার করা হয় এই বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের নববর্ষ পালনের এবছরের থিম হল “কাল ভয়ংকরের বেশে আবার ওই আসে সুন্দর ”।
প্রফেসর শিশির ভট্টাচার্য্য রঙিন মুখোশ তৈরি করতে করতে জানিয়েছেন, এবছর রঙিন মুখোশ গুলি চাহিদা কিন্তু বেশ অন্যরকম। কারণ এটি যেমন করোনার মত অতিমারী থেকে আমাদের রক্ষা করবে, তেমনি আমাদের দেশের নববর্ষ পালনের ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে এটি বানানো হয়েছে, যার ফলে এটিকে মুখে ধারণ করলেও কাউকে কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে না বরং দেখতে সুন্দরই লাগবে। এই মুখোশ বানানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের রং ব্যবহার করা হয়েছে, যেটির দ্বারা একটা অনুষ্ঠানের আমেজ তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে । এর সঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, নববর্ষের ভোরে মঙ্গল-যাত্রা এই দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান। তাই প্রতিবছর এটি হয়ে থাকে। এবছর অভিনবত্ব হিসেবে যোগ করা হয়েছে কিছু স্লোগানকে এবং যার পোস্টার ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দেশের বাইরে। এছাড়াও আমরা একটি ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছিলাম, যেখানে ২৫ জন ছাত্র-ছাত্রী বিভিন্ন রকমের পোস্টার তৈরি করেছে। মোটামুটিভাবে, ৬ই এপ্রিল থেকে আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী মুখোশ এবং প্রপসগুলি তৈরি করা শুরু করে দেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্ট ডিপার্টমেন্টের ডিন নিসার হোসেন বলেছেন, “আমি একটি প্রতীকী মঙ্গল যাত্রার আয়োজন করছি এবং এটি সমস্ত রকম বিধি সতর্কতা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে পালন করা হবে। আমরা কোন সংবাদপত্র বা দূরদর্শন মাধ্যমের সাংবাদিককে এই কাজে নিয়োগ করব না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে করা সমস্ত অনুষ্ঠানের ভিডিও রেকর্ডিং পরবর্তীতে দূরদর্শনে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।”
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এই বর্তমান পরিস্থিতির কারণে সমস্ত ইনস্টিটিউশন এবং অরগানাইজেশনগুলিকে পয়লা বৈশাখ পালনের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ২৯শে মার্চ এফএফএ-র কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সমস্ত সতর্কতাবিধিকে পালন করে ১৪ই এপ্রিল একটি প্রতীকী মঙ্গল যাত্রার আয়োজন করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বাংলাদেশের এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো ২০১৬ সালের ৩০শে নভেম্বর কালচার হেরিটেজ-এর স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।
পরিশেষে বলা, সমস্ত পরিস্থিতির মোকাবিলা করে বাংলাদেশ কিন্তু তাদের পয়লা বৈশাখ-কে নিজেদের ঐতিহ্যের মধ্যে দিয়ে বরণ করে নিয়েছে। তাহলে এবার দেখা ভারতবর্ষে ঠিক কী ঘটতে চলেছে পয়লা বৈশাখে? জানতে হলে চোখ রাখুন ট্রিপটো- বাংলায়।