'এসো হে বৈশাখ এসো এসো ' কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের লেখনীর হাত ধরে নতুন বছরের আগমনবার্তা প্রত্যেকটি বাঙালি আজও অনুসরণ করে চলেছে । আমাদের সকলের কাছেই নতুন বছরের সূচনার দিনটি কিন্তু বেশ স্পেশাল হয় । কারণ কোথাও যেন আমাদের বিশ্বাস যদি বছরের শুরুর দিনটা বিশেষভাবে পালন করা হয় তাহলে সম্পূর্ণ বছরটা আমরা সুষ্ঠ এবং সুন্দরভাবে কাটাতে পারব। বাঙালির নববর্ষ পালনের ইতিহাসটা কিন্ত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।বাংলার রীতি অনুযায়ী এই শুভদিনের সূচনাপর্বে বিভিন্ন জায়গায় প্রভাতফেরীর এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ।
তবে এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল অধরা থেকে যায় মিষ্টিমুখ ছাড়া । বাঙালি সারাবছর মাছে ভাতে থাকলেও এই বাঙালিয়ানার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে মিষ্টি খাদ্যটি জড়িয়ে রয়েছে । তাই বাঙালিদের যে কোনও উৎসবের সর্বাগ্রে মিষ্টি জনপ্রিয়তা পেয়েছে । নববর্ষ উৎসবে ভোজনরসিক বাঙালির ব্যঞ্জনে ভাত, মুচমুচে আলুভাজা, শুক্তো ধোঁকার ডানলা, থেকে ইলিশ ভাপা, কচি পাঁঠার ঝোল ঠাঁই পেলেও, এই ব্যাঞ্জনের শো স্টপার কিন্তু রসগোল্লা, সন্দেশ কিংবা ল্যাংচা জাতীয় মিষ্টান্নগুলি ।
নতুন বছরে পাত পেড়ে মিষ্টিমুখ করার জন্য বিখ্যাত মিষ্টান্ন এবং তার সেরা ঠিকানাগুলি হল -
১. রসগোল্লা -
রসগোল্লার উৎপত্তিস্থল নিয়ে বাংলা ওড়িশার মধ্যে দ্বন্ধ থাকলেও, ছানার তৈরি গরম গরম রসগোল্লা মিষ্টি প্রেমী বাঙালির কাছে একটা আবেগের জায়গা। বাঙালিরা কম বেশি সকলেই এই রসগোল্লার ভক্ত । যে কোনও বিশেষদিন থেকে শুরু করে নিত্য নৈমিত্তিক দিনে মিষ্টি খাওয়ার স্বাদ জাগলে, সেই স্বাদ পূরণের সিক্রেটটা একমাত্র এই রসগোল্লার মধ্যেই রয়েছে । এই রসগোল্লা টেস্ট করার জন্য সেরা ঠিকানা হল - কলকাতার শোভাবাজারের নবীন চন্দ্র দাস এন্ড সন্স ।
২. পান্তুয়া -
বাঙ্গালীর মিষ্টিচর্চায় রসগোল্লা সাথে যে নামটা একাত্ম হয়ে আছে সেটি হল পান্তুয়া । ময়দা এবং ছানা সহযোগে রসেভরা ভাজা মিষ্টি হল পান্তুয়া । এই পান্তুয়ার স্বাদ করতে পৌঁছে যেতে পারেন রানাঘাটের জগু ময়রা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে ।
৩. সন্দেশ -
বাঙ্গালী মিষ্টিরসনার প্রসঙ্গ এলে সন্দেশ মিষ্টান্নটিকে একেবারেই অগ্রাহ্য করা যায় না। কাঁচাগোল্লা, গুড়ের সন্দেশ, মালাই রোল, কিংবা আবার খাব ইত্যাদি মিষ্টিগুলি বেশ জনপ্রিয় । এই সন্দেশের স্বাদ গ্রহণ করতে চাইলে পৌঁছে যেতে পারেন কলকাতার ৫৬ নং রাম দুলাল সরকার স্ট্রিট এর গিরিশ চন্দ্র দে, নকুড় চন্দ্র নন্দী এর বিপণীতে । প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এই বিপণীটি কলকাতা শহরের প্রাচীন মিষ্টান্ন বিপণীগুলির মধ্যে অন্যতম ।
৪. সীতাভোগ -
মিষ্টিপ্রেমী সব বাঙ্গালীর সীতাভোগ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে । সিমুই বা চালের তৈরি ভাতের মতো দেখতে মিষ্টান্নটি ছোট ছোট পান্তুয়া সহযোগে পরিবেশন করা হয় । এই মিষ্টান্নটি দেখতে দর্শনধারী এবং খেতেও কিন্তু অসাধারণ । আর আমরা সক্কলেই জানি সীতাভোগ মানেই বর্ধমান । তাই সময় সুযোগ করে বর্ধমানের গনেশ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্নটি চেখে দেখার সুযোগ মিস করবেন না ।
৫. মিহিদানা -
বর্ধমান শহরে সীতাভোগের সাথে সাথেই জনপ্রিয় মিষ্টান্নটি হল মিহিদানা । বোদের মতো দেখতে হলেও এই মিষ্টিটি আকারে ছোট । তবে বর্তমানে কলকাতা শহরের মিষ্টি বিপণীগুলিতে এই মিষ্টান্নটির দেখা পাওয়া যায়। মিহিদানা টেস্ট করার সেরা ঠিকানা হল - বর্ধমানের গনেশ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।
৬. জলভরা -
সন্দেশ মিষ্টান্নটি একটু নতুন আঙ্গিকে খুঁজে পাওয়া যায় জলভরার মধ্যে । কড়া পাকের এই সন্দেশটির শেষ কামড়ে পেয়ে যাবেন জল । স্বাদের দিক থেকে এই মিষ্টান্নটি কিন্ত অতুলনীয় । সেরা স্বাদের জলভরা খেতে চাইলে আপনি পৌঁছে যেতে পারেন ঐতিহ্যবাহী শহর চন্দননগরে । আর এই জলভরার জনক হলেন চন্দননগরের সূর্য মোদকের বিপণীটি ।
৭. মনোহরা -
বাংলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্নগুলির মধ্যে অন্যতম হল মনোহরা । প্রাচীনকাল থেকে আজও এই মিষ্টিটি বাঙ্গালী হৃদয়কে জয় করে চলেছে । চিনি সহযোগে ছানার তৈরী এই মিষ্টির মধ্যে রয়েছে জিভে জল আনা স্বাদ । মনোহরার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে বিশদে জানতে পৌঁছে যেতে পারেন হুগলির জনাইয়ে, আর এই জনাই শহরের মনোহরা স্বাদের সেরা ঠিকানা হলো - কমল ময়রা মিষ্টান্ন ভান্ডার ।
৮. সরপুরিয়া -
নতুন বছরে মিষ্টিমুখ করার জন্য সরপুরিয়া মিষ্টিটি আপনার খাদ্য ব্যাঞ্জনের তৃপ্তিকে আরও রমনীয় করে তুলতে পারে । কলকাতা শহরে এই দুগ্ধজাত মিষ্টিটি তেমন দেখা পাওয়া যায় না । আর তাই এই প্রাচীন মিষ্টির স্বাদ চেখে দেখার জন্য পৌঁছে যেতে পারেন কৃষ্ণনগরের অধর চন্দ্র দাস এন্ড সন্স-এর বিপণীতে ।
৯. ল্যাংচা -
ছানা ও ময়দা মিস্ত্রিত রসে ভরা এই ভাজা মিষ্টিটি আজও বাঙ্গালীর মনকে পরিতৃপ্তি এনে দেয়। যে কোনও উৎসবে মিষ্টিমুখ করার জন্য এই মিষ্টিটি কিন্তু আদর্শ এবং খেতেও কিন্তু বেশ ভাল। ল্যাংচার প্রসিদ্ধ স্থান হল শক্তিগড় । আর এই শক্তিগড়ের ল্যাংচা টেস্ট করার জন্য ল্যাংচা মহল, ল্যাংচা ভবন কিংবা ল্যাংচা কুঠিকে বেছে নিতে পারেন ।
১০. মেচা সন্দেশ -
এই বাংলার বুকেই বিখ্যাত মিষ্টি প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করলে মিছা সন্দেশকে কোনও ভাবেই বাদ দেওয়া চলে না । ছাতু, ছানা, খোয়া ক্ষীর, চিনি এবং ঘি সহযোগে নির্মিত এই মিষ্টিটি বাঁকুড়া জেলার একটি বিখ্যাত মিষ্টি হিসেবে পরিচিত । অবশ্যই এই মিষ্টান্নটির উৎপত্তি স্থল বাঁকুড়াতেই । আর মেচা সন্দেশের সেরা ঠিকানা হল -বাঁকুড়ার মেচা মহল ।
মিষ্টি সংক্রান্ত গবেষণা করলে বোঝা যায় এই মিষ্টিগুলি প্রাচীন কাল থেকে আজ ও বাঙালির অভিজাত্যকে রক্ষা করে চলেছে । তাছাড়া মিষ্টিপ্রেমী বাঙালি মিষ্টি ছাড়া কি নতুন বছরকে অভ্যর্থনা জানাতে পারে?
সকলকে জানাই শুভ নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছা ।🙏