পৃথিবীতে বসবাসকারী এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা হয়ত একে অন্যের সঙ্গে বহুদিন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রয়েছেন। কিন্তু কিছু কিছু অনুষ্ঠান পালনে কিংবা কোন আচার-নিষ্ঠা পালনের জন্য তারা কখনও কখনও একসঙ্গে হয়ে থাকেন। ঠিক এ-রকমই একটি অনুষ্ঠান হল গুড ফ্রাইডে, যেটি পালন করার জন্য সমাজের যে কোনও প্রান্তে থাকা মানুষ এইদিন পৌঁছে যান তার নিজস্ব গন্তব্যে।
গুড ফ্রাইডের ইতিকথা :-
গুড ফ্রাইডে, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের পালনীয় এক অন্যতম পবিত্র দিন। খ্রিস্ট ধর্ম অনুযায়ী যীশু খ্রিস্টকে ক্রুশ বিদ্ধ করে হত্যা করার পর সমাধি মন্দির থেকে তাঁর পুনরুজ্জীবন লাভ করাকে কেন্দ্র করে এই উৎসব পালন করা হয়। ইস্টার রবিবারের ঠিক আগের শুক্রবারে এই গুড ফ্রাইডে অর্থাৎ শুভ শুক্রবার পালিত হয়। শুধু গুড ফ্রাইডে নয়, এই অনুষ্ঠান বিভিন্ন নামে পরিচিতি পেয়েছে। তার মধ্যে হোলি ফ্রাইডে অর্থাৎ পবিত্র শুক্রবার, ব্ল্যাক ফ্রাইডে অর্থাৎ কালো শুক্রবার, এবং গ্রেট ফ্রাইডে অর্থাৎ মহান শুক্রবার নামগুলি অন্যতম। গুড ফ্রাইডে প্রধানত ইহুদীদের উৎসব পাসওভারের সঙ্গে একই দিনে পালিত হয়।
এই গুড ফ্রাইডে কোথা থেকে এল? কেনই বা তা পালন করা হয়? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে আমাদের পৌঁছাতে হবে সেই পূর্বযুগে যিশু খ্রিস্টর সময়। কথিত আছে, যিশু যখন জেরুজালেমে পৌঁছান তখন সেখানে তাঁকে নিয়ে ইহুদীদের মধ্যে শোরগোল শুরু হয়। তারা মনে করতে থাকেন যিশু খ্রিস্ট এখানে এসেই ইহুদীদের মন্দির ধ্বংস করবেন বলে পরিকল্পনা করেছেন। এরপর যিশু খ্রিস্টের জনপ্রিয়তা দেখে রোমান প্রশাসকরা ভাবলেন যে তিনি হয়তো নিজেকে ইহুদীদের রাজা বলে দাবি করছেন। ফলত, যিশু খ্রিস্টকে তারা এই স্থান থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। ক্রুশ বিদ্ধ হওয়ার আগের দিন রাতে যিশু খ্রিস্ট তাঁর ১২ জন বিশ্বস্ত সঙ্গীদের নিয়ে শেষ খাবার অর্থাৎ লাস্ট সাপার করেছিলেন। তখন তাদের মধ্যে একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী মাত্র ৩০ টি রৌপ মুদ্রার বিনিময়ে যিশু খ্রিস্টকে ধরিয়ে দেন। এরপর তখনকার তৎকালীন রাজা পিলাতের আইনসভায় অন্যায় ভাবে তাঁকে ধরে এনে অপমান করা হয়। প্রথমে তাঁকে বিবস্ত্র করে চাবুক দিয়ে প্রহার করা হয় এবং পরবর্তীতে মাথায় কাঁটার মুকুট পরিয়ে ভারী ক্রুশ বহন করে নিয়ে গিয়ে রোমানীয়রা তাঁকে সেই ক্রুশে বিদ্ধ করেন। শোনা যায়, মৃত্যুর আগে তাঁকে পিত্ত মেশানো আঙ্গুরের রস খাওয়ানো হয় এবং একজন সৈন্য বর্শা দিয়ে তাকে খুঁচিয়ে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করে। ক্রুশ বিদ্ধ অবস্থায় তিনি সাতটি বাণী দেন। যিশু খ্রিস্টের এই কষ্টভোগ এবং পরিত্রাণের জন্য ক্রুশবিদ্ধ হওয়া খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী মানুষের পরিত্রাণ এবং পাপ থেকে মুক্তির মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়, যার ফলে তারা এই দিনটি গুড ফ্রাইডে হিসেবে পালন করেন, যার পূর্ণ বিবরণী খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের নতুন নিয়মের প্রধান চারটি বইতে রয়েছে যা ‘সুসমাচার’ নামে পরিচিত।
তাহলে এবার প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যার জন্যই খ্রিস্ট ধর্মের উৎপত্তি সেই মানুষটির জীবনের এই চরম দুঃখের দিন ব্যাখ্যা করতে কেন ‘গুড’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত আমরা জানি গুড শব্দের আভিধানিক অর্থ হল ভালো। কিন্তু অক্সফোর্ড অভিধান অনুযায়ী গুড শব্দের অর্থ হল পবিত্র। এছাড়াও কেউ কেউ আবার মনে করেন ভগবান অর্থাৎ গড শব্দটির অপভ্রংশ রূপ হল এই গুড। তাই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই দিনটি পবিত্র হওয়ার এটির নাম দেওয়া হয় গুড ফ্রাইডে। অপরদিকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর আনুমানিক ৩০ থেকে ৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যিশু খ্রিস্টকে ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়।
এই নিয়েও নানা মতবাদ আছে। বলা হয়, মহাবিষুবের সময় এই উৎসবটি পালিত হয়। সেই মত অনুযায়ী ৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৩রা এপ্রিল যিশু খ্রিস্টকে ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু এরপর আইজ্যাক নিউটন গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি মেপে ৩৪ খ্রিস্টাব্দকেই মান্যতা দেন। তবে যাই হোক, বাইবেল অনুযায়ী যিশু খ্রিস্ট ক্রুশ বিদ্ধ হওয়ার দিনটি ছিল শুক্রবার। তাই সেই সময় থেকেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে এই শুক্রবারকে গুড ফ্রাইডে হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। জার্মানি সহ বেশ কিছু দেশে এটি ‘দুঃখজনক শুক্রবার’ হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে পূর্ব ইউরোপের চার্চগুলি জুলিয়ান ক্যালেন্ডার এবং পশ্চিম ইউরোপের চার্চগুলি গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার মেনে গুড ফ্রাইডে পালন করে থাকে।
গুড ফ্রাইডে উদযাপনের বিধি :-
• খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা এই দিনটিতে সারাদিন উপবাস করেন এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন।
• প্রতিটি গির্জায় দুপুর থেকে শুরু করে বিকেল তিনটে অবধি প্রার্থনা চলে।
• গির্জার যাজকেরা কালো পোশাক পরেন।
• এইদিন তারা নিরামিষ অথবা ফল খেয়ে থাকেন।
• নানা রকমের ঐতিহ্যশালী হট ক্রস বান বা রুটি বানানো হয়।
• যিশু খ্রিস্টের মৃত্যুতে শোকের ছায়া বোঝাতে অনেকের বাড়িতে ক্রস, চিত্র এবং মূর্তিগুলিকে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
তবে আগের বছর চার্চে গিয়ে গুড ফ্রাইডে পালিত না হলেও, এই বছর করোনার জন্য সমস্ত প্রতিরোধক ব্যবস্থা মেনেই গুড ফ্রাইডে পালন করা হবে।