হিন্দুধর্মের আধার হিসেবে যে তত্ত্বগুলির বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার মধ্যে মূল তত্ত্বটি হল শাক্ততত্ত্ব । এই শাক্ত ধর্মাবলম্বীদের আরাধনার মূল চরিত্রকে একটি রূপক দেবী হিসেবে চিহ্নিত করা যায় এবং শাক্ততত্ত্ব অনুযায়ী, এই দেবীই শাক্ত তথা হিন্দু ধর্মের প্রধান দেবী হিসেবেও পরিচিত। এছাড়াও শাক্তধর্মের তত্ত্ব গুলির মধ্যে দেবীর করুণাময়ী পার্বতী থেকে কালী মূর্তির আবির্ভাব-এর মূল কাহিনিটিই প্রাধান্য পেয়েছে ।হিন্দু শাস্ত্রের শ্রুতি এবং স্মৃতি গ্রন্থে শাক্তধর্মের উদ্ভবের ইতিহাস পাওয়া যায়। এই প্রধান গ্রন্থগুলি ছাড়াও দেবী ভাগবত পুরাণ, কালিকা পুরাণ, শাক্ত উপনিষদে শাক্তধর্ম এবং রীতি নীতি সম্পর্কে বিশদে জ্ঞান লাভ করা যায় ।
ভারতের ৫১টি শক্তিপীঠের অন্যতম এই কামাখ্যা মন্দিরটি আসামের নীলাচল পাহাড়ের পশ্চিমে গুয়াহাটি শহরে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে অবস্থিত ।
মন্দির নির্মাণ এবং বিন্যাস সম্পর্কে কিছু তথ্য
এই শাক্তধর্মের রীতি গুলির মধ্যে প্রধান রীতি হল তন্ত্র সাধনা। আর ভারতে এই তন্ত্র সাধনার মূল পীঠস্থান হলো আসামের কামাখ্যা মন্দির ।সম্পূর্ণ মন্দিরটি পাথর কেটে নির্মাণ করা হয়েছে এবং এই মন্দিরের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি আরোপ করলে জানা যায়, মন্দিরের নির্মাণ এবং পুনঃনির্মাণ করতে ৮ম শতাব্দি থেকে ১৪দশ শতাব্দি বা তার বেশী সময় লেগেছিল বলেই ঐতিহাসিকরা মনে করেন । বর্তমানে মন্দিরটিতে গর্ভগৃহ, তিনটি মণ্ডপ, পঞ্চরত্ন এবং নাটমন্দির রয়েছে ।
মন্দিরের গর্ভগৃহটি রাজধানী শহর তেজপুরের সূর্যমন্দিরের আদলে গঠিত । এই গর্ভগৃহের শিখরটি বাংলার চারচালা আঙ্গিকে নির্মিত । গর্ভগৃহে স্থাপিত আছেন দেবী। এখানে দেবীর কোনও মূর্তি নেই, যোনী আকারে শিলারূপী এখানে দেবীকে উপাসনা করা হয় এবং শিলা মূর্তি সারাবছরই জলমগ্ন থাকে।
গর্ভগৃহ সংলগ্ন কালান্তা বা মণ্ডপটি আটচালা আঙ্গিকে নির্মিত এবং এই কালান্তার পশ্চিমে রয়েছে পঞ্চরত্ন, যা পাঁচটি ছোট ছোট শিখর। এই পঞ্চরত্ন গর্ভগৃহের শিখরের আকারে নির্মিত। নাটমন্দিরটি অহম শিল্পরীতিকে কেন্দ্র করে গঠন করা হয়েছে । এই নাটমন্দিরের দেওয়াল জুড়ে অহম রাজা রাজেশ্বর সিংহ এবং গৌরীনাথ সিংহের লিপি সংকলিত রয়েছে ।
মন্দির নির্মাণের ইতিহাস -
নবম শতাব্দীর মলেচ্ছা রাজত্বের রাজা ভানামালা ভার্মাদেবের লিপি থেকে প্রথম এই কামাখ্যা মন্দিরের পরিচয় পাওয়া যায় । প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতেও অষ্টম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যেই কামাখ্যা মন্দিরের নির্মাণ কার্য শুরু করেন মলেচ্ছা রাজা । পরবর্তীকালে কামরূপের পাল রাজারা যেহেতু তন্ত্রসাধনায় বিশ্বাসী ছিলেন, তাই সেই সময় থেকেই কামাখ্যা মন্দির তন্ত্রসাধনার মূল পীঠস্থানের পরিচিতি পায় ।
মধ্যযুগীয় সময়ে এই মন্দির ধ্বংসের বহু কাহিনির উল্লেখ পাওয়া যায় । উদাহরণস্বরূপ, ১৫৬৫ সালে বাংলার সুলতান সুলায়মান খান-এর মুসলিম জেনারেল কালাপাহাড় এই মন্দির আক্রমণ করেন। তবে কালাপাহাড়ের আক্রমণ সম্পর্কে বেশ কিছু সংশয় রয়েছে । অনেকের মতে ১৪৯৮ সালের কামাতা রাজত্বের রাজা হুসেন শাহ এই মন্দির আক্রমণ এবং ধ্বংস করেন ।
পরবর্তী কালে কোচ রাজবংশের নির্মাতা রাজা বিশ্ব সিংহ প্রথম এই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান । এই বংশের রাজা নর নারায়ণ ১৫৬৫ সালে কামাখ্যা মন্দিরের পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু করেন । এরপর আবারও বিভিন্ন সাম্রাজের আগ্রাসনে মন্দিরের শিল্পরীতি ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। ১৯২৫ সালে অহম সম্রাট কোচ শিল্পরীতিকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য মন্দিরপুনঃগঠনে দৃষ্টিপাত করেন। এছাড়াও সেই সময় শাক্ত ধর্মমত প্রচারের জন্য ও এই মন্দির পুনঃ গঠন প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল।
কিছু ইতিহাসবিদদের মতে এই মন্দিরে আদিবাসী দেবী কমেইখার বহু সূত্র মিলেছে । প্রধানত খাসি এবং গারো জনজাতির আরাধ্য দেবী হলেন এই কমেইখা। কালিকা পুরাণ এবং যোগীনি তন্ত্র নামক গ্রন্থেও দেবী কমেইখার কিরাটা সূত্রের খোঁজ পাওয়া যায় ।
কামাখ্যা দেবীর আধ্যাত্মিক ইতিকথা -
কামাখ্যা দেবী মূলত তান্ত্রিক দেবী হিসেবে পরিচিত । যিনি সিদ্ধ কব্জিকা রূপ অর্থাৎ কালী এবং ত্রিপুরা সুন্দরী দেবীর সম্মিলিত দেবী হিসেবে আরাধনা করা হয় । কালিকা পুরাণ এ দেবী কামাখ্যা সম্পর্কে বর্ণিত আছে - ভগবান শিব এর তরুণী পত্নী কামাখ্যা দেবী সমস্ত ইচ্ছার পরিপূরক এবং তিনি একই সঙ্গে মানুষের মোক্ষ লাভ করান ।তন্ত্র মতে দেবী কামাখ্যা সৃষ্টির আধার হিসেবে ও পরিচিত ।
কামাখ্যা মন্দিরের প্রধান উৎসব -
কামাখ্যা মন্দিরে নবরাত্রি, মনসা পূজা, আসামের স্থানীয় উৎসবগুলি জাঁক জমকের সাথে পালন করা হয় । তবে এই মন্দিরের প্রধান উৎসব হল অম্বুবাচি মেলা । অসমিয়া ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অহর মাসেই এই উৎসব পালন করা হয়। প্রতিবছর দেবীর রজঃস্বলা সময়কে কেন্দ্র করেই এই উৎসবের আয়োজন করা হয় । কথিত আছে এই সময়কালীন তিনদিন ব্যাপী ব্রহ্মপুত্র নদীর জল ও লাল রঙে রঞ্জিত হয়ে যায় । সারাবছর নিত্য পুজো এবং দেবী দর্শনের সুযোগ থাকলেও আম্মুবাচির সময় তিনদিন মন্দির সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। এই সময় মন্দিরে এমনকি আসাম রাজ্যেও কোনও রকম শুভ কাজ সম্পাদন করা হয় না। তবে ঐতিহ্যবাহী রীতি মেনে এই সময় আম্মুবাচির মেলা বসে, এই মেলাতে বহু তান্ত্রিক সাধকদের দেখা মেলে যারা বছরের অন্যান্য সময় সাধনায় মগ্ন থাকেন ।
কামাখ্যা মন্দিরের পার্শবর্তী দর্শনীয় স্থান -
আসামের কামাখ্যা মন্দিরের পার্শবর্তী দর্শনীয় স্থানগুলি হল উমানন্দ আইল্যান্ড, আসাম স্টেট মিউজিয়াম, গুয়াহাটি চিড়িয়াখানা, পবিতরা অভয়ারণ্য, বশিষ্ট আশ্রম ইত্যাদি ।
কীভাবে যাবেন -
বিমানে - কলকাতা থেকে বিমানে চেপে পৌঁছে যান লোকপ্ৰিয় গোপীনাথ বরদলোই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর । বিমান বন্দর থেকে গাড়ি ভাড়া করে ২০ কিমি পথ অতিক্রম করে পৌঁছে যান গন্তব্যে ।
ট্রেনে - হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে পৌঁছে যান গুয়াহাটি স্টেশন। স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে মাত্র ৮কিমি যাত্রা অতিক্রম করে পৌঁছে যান কামাখ্যা মন্দির।