গত বছর অক্টোবর মাস থেকে সমগ্র ভারতবাসীর মনে কিছুটা হলেও নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল, হয়তো আমরা এবার করোনা মহামারীর প্রকোপ থেকে মুক্তি পেতে চলেছি । আমাদের সকলের মনের মধ্যে একটা বিশ্বাসের ভীত গড়ে উঠছিল নতুন বছরে অর্থাৎ ২০২১-এ হয়তো আমরা আবার করোনা মুক্ত বিশ্ব তথা ভারতবর্ষকে খুঁজে পাব। আবারও রোগমুক্ত পরিবেশে বিশুদ্ধ নিশ্বাস নিতে পারব কিংবা আবার ও স্বাধীনভাবে দেশান্তরিত হতে পারব। এককথায় নতুন বছরের কাছে আমাদের সকলেরই একটাই কাম্য ছিল- ' করোনা গো আহেড' বা 'গো করোনা গো '।
কিন্তু নতুন বছরের সেই মার্চ ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে রোগ মুক্তি প্রসঙ্গে বিশ্বাসের ভীতটা আবারও নড়বড়ে হয়ে উঠেছে । তাহলে কি সেই করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ রূপটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠছে? নাকি সেই মারণরোগের আরও শক্তিশালী রূপের উদ্রেক হয়ে উঠতে চলেছে, সেই বিষয়ে মানুষের মনে নতুন করে সংশয় দেখা দিয়েছে । সংবাদমাধ্যমের তরফ থেকে জানা যাচ্ছে, প্রায় প্রতিদিনই সেলিব্রিটি থেকে সাধারণ মানুষ করোনার কবলে জর্জরিত হচ্ছেন।
তবে বাজারে টিকাকরণ পদ্ধতির আবির্ভাব ঘটলে আমরা ভেবেছিলাম, যাক বাবা, এবার হয়তো টিকার সাহায্যে এই রোগের প্রকোপ থেকে রেহাই পাব। কিন্তু যখন জানলাম টিকা গ্রহণ করেও এই রোগ থেকে পুরোপুরি নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না, তখন সেই বিশ্বাসও কিছুদিনের মধ্যেই তছনছ হয়ে গেল। মহামারীর করালগ্রাস গোটা দুনিয়াকে আবার বন্দি করতে চলেছে । ইতিমধ্যে জানা যাচ্ছে ভারতে দৈনিক সংক্রমণ ৬০,০০০ ছুঁয়েছে । এক্ষেত্রে আক্রান্ত রাজ্যগুলোর শীর্ষে রয়েছে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব, দিল্লি। তবে বাংলায় সংক্রমণ তুলনায় কিছুটা কম হলেও করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় তরঙ্গের ভয়াবহ আশঙ্কাকে উপেক্ষা করা যায় না ।
চলুন দেশের আক্রান্ত রাজ্যগুলির করোনা মহামারীর সংক্রমণ রোধের নতুন নিয়মগুলি জেনে নেওয়া যাক -
যেহেতু মহারাষ্ট্র নতুন করে করোনা মহামারী সংক্রমণের শীর্ষে রয়েছে তাই মহারাষ্ট্র সরকার কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু নতুন নিয়ম লাগু করেছে এবং ১লা এপ্রিল পর্যন্ত নাইট কার্ফু জারি করেছে। গত ২৭শে মার্চ ২০২১ মহারাষ্ট্র সরকারের একটি বিবৃতি অনুযায়ী জানা যায় -
• বাড়ি থেকে মাস্ক না পরে বেরোলে প্রতিটি মানুষের ২০০- ৫০০ টাকা জরিমানা হতে পারে ।
• সন্ধে ৮টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কোনও স্থানে একসাথে ৫জনের বেশী মানুষ জমায়েত করতে পারবেন না ।
• সন্ধে ৮ টার পর কোনও পার্ক, সমুদ্র সৈকত, প্রেক্ষাগৃহ কিংবা হোটেলে ভ্রমণ করা যাবে না ।
• নাইট কার্ফু চলাকালীন সময়ে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় জনসমাবেশশের অনুমতি থাকলেও তা নির্দিষ্ট পরিমাণ জনতাকে কেন্দ্র করেই আয়োজিত হবে ।
• বিবাহের ক্ষেত্রে আমন্ত্রিত অতিথি ৫০জন এবং শ্রাদ্ধ শান্তি অনুষ্ঠানে ২০জনের বেশি জমায়েত করা যাবে না।
• ভ্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে বিশেষত দিল্লি, রাজস্থান, গুজরাট, গোয়া এবং কেরালার পর্যটকদের মহারাষ্ট্র ভ্রমণের জন্য অন্ততপক্ষে ৭২ঘণ্টার মধ্যে RT-PCR রিপোর্টটি অবশ্য প্রয়োজন। বিদেশি পর্যটকদের জন্য RT- PCR রিপোর্ট ছাড়াও ভারত ভ্রমণের ১৪দিন আগের ভ্রমণের ইতিহাস সম্পর্কে একটি সেলফ ডিক্লারেশন ফর্ম এয়ার সুবিধা পোর্টালে জমা করা প্রয়োজন ।
সংক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি কর্ণাটক । তবে এই রাজ্যের সিংহভাগ আক্রান্ত হয়েছেন ভারতের আইটি হাবের পীঠস্থান ব্যাঙ্গালুরু থেকে । ইতিমধ্যে জানা গিয়েছে ব্যাঙ্গালুরু একটি পাবে একসঙ্গে ১৬জন কর্মী করোনা পজিটিভ হয়েছেন। সেই কারণে পাব কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্ট কালের জন্য পাব বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সংক্রমণে রাশ টানতে এই রাজ্যের লকডাউনের পরিকল্পনা না থাকলেও কয়েকটি নিয়ম লাগু করেছেন -
• মাস্ক পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘন ঘন স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া অবশ্যই জরুরি।
• দূরত্ব বজায় রাখা ছাড়াও বয়স্কদের অযথা সামাজিক অনুষ্ঠানে জমায়েত করার প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন ।
• এই রাজ্যে প্রবেশ করার আগে RT-PCR রিপোর্টটি প্রয়োজন ।
করোনা সংক্রমণের গতিকে দমন করতে তামিলনাড়ু 'টেস্ট, ট্র্যাক এন্ড ট্রিট ' পদ্ধতিতে বিশ্বাসী । আর এই পদ্ধতি অনুসরণ করার পরও যদি মহামারীকে আয়ত্তে আনা না যায় তাহলে শেষপর্যন্ত লকডাউনের পথ বেছে নিতেও তামিলনাড়ু সরকার রাজি । ব্যবসা সংক্রান্ত কাজ থাকলে ভারতীয় পর্যটকদের ১৪ দিন গৃহবন্দি থাকতে হবে না এবং তিনদিনের মধ্যেই কাজ সেরে ফেলতে হবে । এছাড়াও ভ্রমণকালীন সময়ে রাজ্য সরকারের ই -পাস ব্যবহার করতে হবে । বিদেশি পর্যটকদের তামিলনাড়ুর বিমানবন্দরগুলিতে করোনার টেস্ট করা হবে । আর ভারত ভ্রমণের আগে একটি সেলফ ডিক্লারেশন ফর্ম এয়ার সুবিধা পোর্টালে জমা করতে হবে ।
পাঞ্জাব রাজ্যটিও করোনা ভাইরাস ২.০ এর ভয়াল নজর থেকে পরিত্রাণ পায়নি । তাই পাঞ্জাব সরকার কর্তৃপক্ষ ১১টি জেলায় ৩১শে মার্চ পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । এছাড়াও সিনেমা হল গুলিতে ৫০% শতাংশের বেশি দর্শকের অনুমতি নেই । এছাড়াও এপ্রিলের ১০তারিখ পর্যন্ত রাত ৯টা থেকে নাইট কার্ফু জারি করা হয়েছে । পাঞ্জাবেও অতিথিদের আগমনের প্রাক্কালে RT-PCR রিপোর্ট এর প্রয়োজন ।
দিল্লি -
রাজধানী শহর দিল্লিও সংক্রমণ রোধের জন্য কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে । হোলি এবং অন্যান্য উৎসবের প্রাক্কালে উৎসব পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে । এর পাশাপাশি মাস্ক পড়া, দূরত্ব বজায় এবং যত্রতত্র মানুষের থুতু ফেলার প্রতিও দৃষ্টি আরোপ করা হয়েছে। দিল্লি ভ্রমণের পূর্বে কমপক্ষে ৭২ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষিত RT-PCR রিপোর্ট-এর প্রয়োজন ।
কোভিড সংক্রমণ রোধ করার উদ্দেশ্যে গুজরাত সরকার কর্তৃপক্ষও রাজ্যের প্রধান শহরগুলিতে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত নাইট কার্ফু জারি করেছেন । গুজরাতেও পর্যটকদের প্রবেশের জন্য RT-PCR রিপোর্ট প্রয়োজন ।
উত্তরাখণ্ড রাজ্যটি পর্যটকদের উদ্দেশ্যে বিশেষত মহারাষ্ট্র, কেরালা, পাঞ্জাব, কর্ণাটক, ছত্তিশগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, গুজরাত, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, রাজস্থান সব মিলিয়ে ১২টি রাজ্যের পর্যটকদের উত্তরাখণ্ড রাজ্যে প্রবেশিকাধিকার পাওয়ার জন্য RT-PCR রিপোর্ট বাধ্যতামূলক করেছেন ।
পরিশেষে বলবো আপনারা নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন ও সতর্ক হন। সরকারী বিধি গুলি যথাযথ ভাবে পালন করুন । শারীরিক অসুবিধা থাকলে নিভৃতবাসে থাকুন । চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখুন । আশা রাখি, শীঘ্রই আমরা করোনা মুক্ত পরিবেশে ফিরে যেতে পারব ।