পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, নেপাল এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য পাহাড়ি অঞ্চল মিলিয়ে প্রায় ৮০,০০০ লেপচা জনজাতির মানুষ বসবাস করেন। ভুটান, দার্জিলিং, গ্যাংটক, বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের সময় আমরা প্রায় সকলেই লেপচা সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। বর্তমানে বহু লেপচা পরিবার পাহাড়ি অঞ্চলগুলিতে পর্যটকদের জন্যে হোম-স্টে চালু করেছেন এবং এর ফলে লেপচা সম্প্রদায়ের মানুষরা আমাদের আরও কাছাকাছি চলে এসেছেন।
সহজ সরল, অতিথিবৎসল এবং ধর্মপ্রাণ এই মানুষগুলির কাছ থেকে আমরা জানতে পারি তাঁদের লোকাচার এবং ধর্মবিশ্বাসের কথা। লেপচারা মনে করেন বহু প্রজন্ম পূর্বে তাঁদের উৎপত্তি হয়েছিল এই শ্বেতশুভ্র, পাহাড়ঘেরা অঞ্চলের মাটিতেই। তাঁরা পৃথিবী এবং জাগতিক সংসারের সৃষ্টিকারী আদিনারীশক্তির বরপুত্র। আসুন জেনে নিই লেপচা সম্প্রদায়ের আবির্ভাবের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে কোন লোকগাথা।
লেপচা উপকথা - প্রথম প্রাণের সঞ্চার
লেপচারা মনে করেন এই জগৎসংসার, পৃথিবী তথা ত্রিভুবন সৃষ্টি করেছেন দেবী ইতবু-মু। তিনিই সৃষ্টি করেছিলেন পৃথিবী, কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতমালা এবং আশেপাশের সকল নদী এবং হ্রদ। কিন্তু পৃথিবী সৃষ্টির পরে দেবীর মনে হয়েছিল যে এই পৃথিবী বড়ই নীরব, প্রাণহীন। তাই কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া হতে এক মুঠো বরফ তুলে নিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন প্রথম পুরুষ, যার নাম ফুডংথিং। আর ফুডংথিং-এর মজ্জা (লেপচা মতে মজ্জা হল অভিজ্ঞতা এবং প্রাজ্ঞতার প্রতীক) হতে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন প্রথম মানবী - নাজং নিউ।
ফুডংথিং এবং নাজং নিউ এর সৃষ্টির পরে ইতবু-মু তাঁদেরকে দান করেন অলৌকিক শক্তি এবং ক্ষমতা। ফুডংথিংকে তিনি থাকার জন্যে দেন সুউচ্চ এক পাহাড়চূড়া। আর নাজং-নিউকে তিনি থাকতে দেন ওই পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত হ্রদের কাছে এবং তিনি তাঁদেরকে এই সতর্কবাণী দিয়ে যান তাঁরা যেন আলাদা আলাদা থাকে, নিজেদের মধ্যে মিলিত না হয়ে।
লেপচা উপকথা - মর্ত্যলোকে প্রাণের আগমন
তাঁরা ছিলেন প্রথম মানব এবং মানবী। বহু শতাব্দী দূরে দূরে থাকার পর একসময় উভয়েই হয়ে ওঠেন নিঃসঙ্গ, এবং তাঁদের শয়নে স্বপনে জুড়ে বসে অপরজনের চিন্তা। অবশেষে বিরহ সহ্য করতে না পেরে নাজং নিউ তৈরি করেন এক সোনার সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে হ্রদ থেকে চূড়ার দিকে উঠতে গিয়ে তারকল-পারতাম নামক সমতল ভূমিতে তাঁদের সাক্ষাৎ শুরু হয়।
ইবতু-মু-র নিষেধাজ্ঞা না শুনে ফুডংথিং এবং নাজং নিউ প্রণয়ে মেতে ওঠেন। অনতিকাল পরেই নাজং নিউয়ের গর্ভে সঞ্চার হয় নতুন প্রাণের। তবে সেই সন্তানের জন্মের পর ফুডংথিং এবং নাজং নিউ উভয়েই ভয় পেয়ে যান এবং ইবতু মুর ক্রোধের ভয়ে তাঁরা তাদের সন্তানকে রেখে আসেন পাহাড়ি কোনও গুহার মধ্যে। একে একে সাতবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং ফলস্বরূপ ৭ টি শিশুকে পাহাড়ের আনাচে কানাচে পরিত্যাগ করা হয়।
ইতিমধ্যে ইবতু মু এই ঘটনা জানতে পারেন এবং ফুডংথিং ও নাজং নিউকে ডেকে পাঠান। তাঁদের কৃতকর্মের শাস্তি হিসেবে তিনি তাঁদের সকল দৈবিক শক্তি হরণ করেন এবং সাধারণ মানুষের মতো বাঁচার আদেশ দেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার পাদদেশে বসবাস করতে বলেন। দেবলোক থেকে মর্ত্যে তাঁদের জীবনশক্তির পতন ঘটে।
লেপচা উপকথা - কীভাবে হল মানবসমাজের বিস্তার
ইবতু মু-র অভিশাপে তাঁরা সাধারণ মানুষের মতন স্বামী স্ত্রী রূপে কাঞ্চনজঙ্ঘার পাদদেশে বসবাস শুরু করেন এবং একে একে তাঁদের বেশ কিছু সন্তান-সন্ততি জন্মগ্রহণ করে। নুংলেনইউ এবং কথংফি তাঁদের প্রথম পুত্র এবং পুত্রী। তাঁদের দ্বিতীয় পুত্র ও পুত্রীর নাম যথাক্রমে নুমশিমনিউ এবং নুমবংথিং।
বহু বছর ধরে মানুষ রূপে ফুডঙথিং ও নাজং নিউ এর কৃচ্ছসাধনে খুশি হয়ে ইবতু মু তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং তাঁদের পরিবারকে আশীর্বাদ করেন। তিনি আশীর্বাদ করেন যাতে শতাব্দীর পর শতাব্দী এই পরিবারের বংশ বিস্তার হয় এবং তারা যেন সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে। এঁরাই কাল ক্রমে পরিচিত হন লেপচা জনপ্রজাতি হিসেবে। ইবতু মুর আশীর্বাদে নুংলেনইউ এবং কথংফি হয়ে ওঠেন যথাক্রমে পুরুষ এবং মহিলা লেপচাদের জন্ম এবং মৃত্যুর ধারক ও বাহক। নুমশিমনিউ, নুমবংথিং এবং তাঁদের পরিবার হয়ে ওঠে লেপচা সমাজের আদি পরিবার।
লেপচা উপকথা - অশুভের আগমন
আর সেই যে সাত শিশুকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল পাহাড়ে, জঙ্গলে, নানান অন্ধকার গুহায়, তাদের কী হল? কালক্রমে তারাই হয়ে উঠল মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক এক বিপর্যয়ের অশুভ আত্মা - রুমদু মুং হয়ে ওঠে গুটি বসন্তের দৈত্য, দোম মুং হয়ে ওঠে কুষ্ঠ রোগের দৈত্য। তাঁদের মধ্যে থেকেই জন্ম নেয় ঈর্ষা, অলসতা, সাপ খোপ ক্ষতিকারক কীট পতঙ্গ, এমনকি মৃত্যুর। ফলে দেখা যায় মানবসমাজের উৎপত্তি এবং মানব সমাজের নানান দুঃখের কারণ সৃষ্টি হয়েছে একই উৎস থেকে।
লেপচা লোকাচার এইভাবেই মানব সমাজ এবং প্রকৃতির ভালো এবং খারাপের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়ে দিয়ে গেছে তাঁদের মিথ এবং বিশ্বাসের মাধ্যমে। কে জানে, হয়তো পরবর্তী কোনও পাহাড় ভ্রমণের সময় কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ শোভা দেখার সময় আপনিও অংশীদার হতে পারেন ইবতু-মুর আশীর্বাদের।