বসন্তের প্রাক্কালেই যে লাইনগুলি মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় তা হল ' আহা আজি এ বসন্তে এতো ফুল ফোটে, এতো বাঁশি বাজে, এতো পাখি গায় '। শীতের শুষ্ক দিনের পর যখন বসন্ত নিজের আগমন বার্তা নিয়ে আসে, তখন প্রকৃতির মতো মানুষের মনের মধ্যেও নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার হয় । আর এই বসন্ত মানেই বসন্ত উৎসব অর্থাৎ দোল বা হোলি । প্রতি বছর এই দোলের অপেক্ষায় থাকে আপামর বাঙালি। কারণ, দোল উৎসব হল আনন্দ, সম্প্রীতি, বন্ধুত্ব এবং অবশ্যই প্রেম উদযাপনের দিন । কিন্তু এই রঙের মাদকতা অধরা থেকে যায় পেটপুজো ছাড়া । তাই এই ব্লগে রয়েছে দোল উৎসবের আনন্দকে আরও রঙিন করে তোলার জন্য কয়েকটি খাবারের সন্ধান।
মুখরোচক খাদ্য -
সিঙ্গাড়া -
বাঙালিদের সবচেয়ে পছন্দের মুখরোচক খাবার সম্পর্কে আলোচনা শুরু হলে যে খাদ্যটিকে এক্কেবারেই অস্বীকার করা যায় না সেটি হল সিঙ্গাড়া। দোলের দিনটা যদি এই খাস্তা মচমচে সিঙ্গারা দিয়ে শুরু হয়, তাহলে জাস্ট জমে যাবে । কলকাতা শহরের সিঙ্গাড়া মানেই হল ফুলকপির সিঙ্গাড়া আর এই ফুলকপির সিঙ্গাড়ার প্রসিদ্ধ স্থান হল লাটুবাবু লেনের গুরুপ্রিয় মিষ্টান্ন ভান্ডার ।
কচুরি -
উৎসবের সকালে বাঙালির খাদ্য রসনা অধরা থেকে যায় কচুরি ছাড়া । পুরভরা খাস্তা কচুরির সঙ্গে আলুর সব্জির স্বাদটা কল্পনা করলে অনায়াসেই জিভে জল চলে আসে । আর আপনি যদি কচুরি প্রেমিক হয়ে থাকেন, তাহলে কলকাতার হাতিবাগানে গদার কচুরির স্বাদ চেখে দেখতে কিন্তু ভুলবেন না । গদার কচুরির দোকানটি প্রায় ৬০ বছরের প্রাচীন, আর এই দোকানটি শুধুমাত্র মহিলাদের দ্বারাই পরিচালিত হয়।
এছাড়াও শ্যামবাজারের হরিদাস মোদকের খাস্তা কচুরিও বেশ জনপ্রিয় ।
ঘুগনি -
দোলের দিনে ঘুগনি দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করতে পারেন। টক ঝাল এই ঘুগনির মধ্যে রয়েছে জিভে জল আনা স্বাদ। বাঙালির এই চটপটে খাবারের সেরা ঠিকানা হল হাজরার যতীন দাস পার্কের কাছে বাসুদার ঘুগনি।
মোগলাই পরোটা -
উৎসবের সন্ধেটা জমে যেতে পারে মোগলাই পরোটার সঙ্গে। পুরভরা পরোটার সঙ্গে শুকনো ঝাল ঝাল তরকারি স্বাদটা অসাধারণ । এই মোগলাই পরোটার শ্রেষ্ঠত্ব খুঁজে পাবেন ধর্মতলার অনাদি কেবিনে ।
মিষ্টি -
রসগোল্লা -
রসগোল্লা ছাড়া বাংলার কোনও উৎসব সম্পূর্ণ হয় না। রসে ভরা গরম গরম রসগোল্লা বাঙালির কাছে একটা আবেগের জায়গা। কলকাতার রসগোল্লা নির্মাণকারী নবীন চন্দ্র দাসের রসগোল্লা ছাড়াও চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের রসগোল্লাও বেশ প্রসিদ্ধ ।
ল্যাংচা
সমস্ত বাঙালি মানুষই কম বেশি মিষ্টিপ্রেমী । আর দোলের দিনে মুখমিষ্টি করার জন্য ল্যাংচা অন্যতম শ্রেষ্ঠ। বাংলাতে ল্যাংচার পীঠস্থান হল বর্ধমানের শক্তিগড়। এখানে ল্যাংচা টেস্ট করার জন্য সমস্ত দোকানগুলি বেশ পরিচিত, তবে এখানকার ল্যাংচা ভবন এই ভাজা মিষ্টির জন্য বিশেষভাবে জনপ্রিয় । শোনা যায় বাঙালির নস্টালজিয়ার মহানায়ক উত্তমকুমারও ল্যাংচার স্বাদ আহরণের জন্য এই ল্যাংচা ভবনে আসতেন ।
মালপোয়া -
সমগ্র ভারতে রং খেলার সাথে যে মিষ্টান্নটি একাত্ব হয়ে আছে সেটি হল মালপোয়া। আর মিষ্টিপ্রিয় বাঙালির কাছে ময়দা, সুজি মিশ্রিত রসে ভেজা মচমচে মালপোয়া বেশ প্রিয়। কলকাতায় মালপোয়ার স্বাদ চেখে দেখতে চাইলে বাঞ্চারাম মিষ্টির বিপণিগুলি ট্রাই করে দেখতে পারেন।
দরবেশ -
দরবেশ মিষ্টিটি তেমনভাবে জনপ্রিয়তা না পেলেও স্বাদের দিক থেকে কিন্তু অসাধারণ । এই মিষ্টান্নটির মধ্যে ঝরঝরে বোঁদে খোয়া ক্ষীর, কাজু বাদাম আর কিসমিশের একটা অসাধারণ কম্বিনেশন আছে । দরবেশ চেখে দেখতে হুগলির রিষড়ার ১৭৫ বছরের প্রাচীন ফেলু মোদকের বিপণিতে পৌঁছে যেতে পারেন। তবে কলকাতার সেন মহাশয়ের দরবেশও বেশ বিখ্যাত। তবে এখানে দরবেশ লাড্ডুর আকৃতির হয় ।
লাড্ডু -
রঙের উৎসবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত মিষ্টান্নটি হল লাড্ডু । জিভে জল আনা লাড্ডু টেস্ট করতে কলকাতার আমহের্স্ট স্ট্রিট-এর পুঁটিরাম বেশ জনপ্রিয় ।
পানীয় -
ঠান্ডাই -
যেহেতু দোল উৎসব পালিত হয় গ্রীষ্মের প্রাক্কালে, তাই এই সময় আবহাওয়া বেশ উষ্ণ থাকে । এই গরম থেকে ক্ষনিকের আরাম পেতে ঠান্ডাই বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে । এই ঠান্ডাই চেখে দেখার জন্য পৌঁছে যেতে পারেন হাতিবাগানের শিব আশ্রমে।
লস্যি -
দোল উৎসবে ঠান্ডাই-এর পর যে পানীয়টি বেশ প্রসিদ্ধ তা হলো লস্যি । দই দ্বারা নির্মিত এই পানীয় একই সাথে সুস্বাদু এবং উপকারীও । তীব্র গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে রাস্তার মোড়ে বহু লস্যি বিক্রেতার স্টল বসে, তবে কলকাতার ভবানীপুরের বলবন্ত সিং ইটিং হাউসের লস্যির স্বাদটা সাধারণ লস্যির স্বাদের তুলনায় অন্যরকম ।
পরিশেষে এইটুকু বলব সকলে খুব আনন্দ করে ভুড়িভোজের সঙ্গে রঙের উৎসব পালন করুন । তবে উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হওয়ার আগে কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখবেন -
১. করোনাকালীন সময়ে সরকারি নিয়মাবলী- যেমন দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পড়া, বার বার হাত ধোয়া ইত্যাদি বিধিগুলি মাথায় রাখবেন।
২.শারীরিক কোনও অসুবিধা বিশেষত জ্বর থাকলে নিজেকে গৃহবন্দি করে নিন এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খান । শারীরিক সমস্যা নিয়ে দোল খেলার প্ল্যান করবেন না ।
৩. রাস্তার অবলা জীব কুকুর বিড়াল, গরুদের গায়ে অযথা রং দেবেন না । কারণ রঙের কেমিক্যালগুলি থেকে এই জীবগুলির ত্বকে খুব খারাপ প্রভাব পড়ে, এমনকি ওদের মৃত্যুও হতে পারে ।
সকলে নিরাপদে এবং সুস্থ ভাবে দোল উৎসব পালন করুন ।
শুভ দোলপূর্ণিমা 🙏