ভারতের ইতিহাসের পাতাগুলিতে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় তৎকালীন শাসকদের সমগ্র ভারতের মধ্যে বাংলাকে অধিগ্রহণ করার ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টা দুইই খুব তীব্রভাবে লক্ষ করা যায় । কারণ সেই সময় বাংলা কৃষিকার্য এবং শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান পীঠস্থান ছিল । তবে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত শ্রীরামপুর শহরের বিকাশের কাহিনিটা বাংলার ইতিহাসকে বিশেষভাবে উজ্জ্বল করে তোলে । কিন্তু এই ঐতিহ্যবাহী শহরের ইতিহাসটা অনেকের কাছেই অজানা । এই শহর পরিক্রমা করে শ্রীরামপুর শহর তথা ভারতের অজানা ইতিহাসটা জেনে নেওয়ার প্ল্যানটা কিন্তু বেশ এক্সসাইটিং হতে পারে ।
শ্রীরামপুরের প্রাচীন ইতিহাস
স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, শ্রীরামপুর শহরের পত্তন কলকাতা উৎপত্তির ৫০০ বছর আগে। ১৪শ এবং ১৫শ শতকে শ্রীরামপুর শহর বিশ্ব বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল । সেই সময় তুলা, তৈল বীজ, চিনি এবং মশলা রপ্তানি করা হত বিভিন্ন এশিয়া এবং ইউরোপীয় দেশগুলিতে। এছাড়াও দেশ-বিদেশ জুড়ে রেশম এবং সুতিশিল্পের বেশ খ্যাতি ছিল।
শ্রীরামপুরে ডেনিশ উপনিবেশিকরণ -
১৭৫৫ সালে ডেনিশ এশিয়াটিক কোম্পানি শ্রীরামপুরে তাদের উপনিবেশ গড়ে তোলেন। ডেনিশদের কলোনি গড়ে তোলার প্রধান কারণ ছিল শুধুমাত্র বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। সেই সময় ডেনিশদের এই বাণিজ্যনগরীটি ডেনমার্কের রাজা ফ্রেডেরিকের নাম অনুসারে ফ্রেদেরিক্সানাগোর নামে পরিচিত ছিল, পরবর্তীকালে যা শ্রীরামপুর নামে পরিচিতি পায় ।
১৭৭৭ সালে তৎকালীন ডেনিশ গভর্নর ওলি বী-এর শাসনকালে শ্রীরামপুর শহর প্রভূত উন্নতি লাভ করে । এই সময় শ্রীরামপুরের শাসন ক্ষমতা ডেনিশ এশিয়াটিক কোম্পানির পরিবর্তে ডেনিশ রাজত্বের অন্তর্ভূক্ত হয় এবং যা পরবর্তীকালে ডেনিশ রাজত্বের বৃহত্তম শহরের পরিচয় পায়। বি হুগলি নদীর তীর বরাবর একটা চওড়া রাস্তা নির্মাণ করেন এবং রাস্তার গা ঘেঁষে তৎকালীন স্থাপত্যকে কেন্দ্র করে বিশালকার ডেনিশ ম্যানশন তৈরি করেন । এছাড়াও শ্রীরামপুর শহরের অলিগলি জুড়ে ডেনিশ নির্মিত বিভিন্ন স্থাপত্যের নজির রয়েছে । ভারতের ইতিহাসে শ্রীরামপুর শহর শ্রেষ্ঠ সংরক্ষিত ইউরোপিয়ান নিদর্শনাগার হিসেবেও পরিচিত ।
প্রাক উপনিবেশিক শাসনকাল -
তবে ডেনিশ ঔপনিবেশিকতার পূর্বে শ্রীরামপুরের সংস্কৃতি বেশ উন্নত ছিল। এই শ্রীরামপুর শহরের প্রাচীন অঞ্চলগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান হল চাতরা । সেই সময় চাতরা ছিল বৈষ্ণবদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র । এই তীর্থক্ষেত্রের বিকাশের জন্য প্রধান তিনটি মন্দির হল - চাতরার দোল মন্দির, রাধা-বল্লব মন্দির এবং মাহেশের জগন্নাথ মন্দির ।
শ্রীরামপুরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরণ -
ভারতের উপনিবেশিকতার প্রসার তীব্র ভাবে লক্ষ করা যায় ব্রিটিশ শাসনকালে । ১৮শ শতকে যখন ব্রিটিশরা ভারতে তাদের আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন, সেই সময় ডেনিশরা শ্রীরামপুরের শাসনব্যবস্থাকে বিক্রি করে দেন । ডেনিশরা যেমন শ্রীরামপুরে শিল্পের প্রসার ঘটিয়েছিলেন,তেমনি ব্রিটিশদের হাত ধরেই শ্রীরামপুরে শিক্ষার অগ্রগতি হয় ।
শ্রীরামপুরে ব্রিটিশ শাসন গড়ে ওঠার আগে অর্থাৎ ১৮০০ সালে বিখ্যাত ইংরেজ খ্রিষ্টান মিশনারী উইলিয়াম ক্যারি শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে শ্রীরামপুর আসেন। সেই সময় ডেনিশ গভর্নর ওলি বী-এর সাহায্যে ক্যারি এবং তার দুই সহযোগী যাশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড (উইলিয়াম ক্যারি, জাশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড 'শ্রীরামপুর ট্রিও' নামে পরিচিত ) শ্রীরামপুর মিশন নির্মাণ করেন ।
শ্রীরামপুর মিশন ভারতে নবজাগরণের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকার অংশীদার, কারণ এই মিশন থেকেই ভারতের প্রথম ছাপা অক্ষরে বই এবং খবরের কাগজ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৮১৮ সালে উইলিয়াম ক্যারি, জাশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড নির্মাণ করেন শ্রীরামপুর কলেজ । এছাড়াও ব্রিটিশ শাসন কালে এই শ্রীরামপুরে নির্মিত হয় হাওড়া ওয়াটার ওয়ার্কস । ১৮৯৪ সালে চার্লস আলফ্রেড এলিয়ট বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের জন্য এই ওয়াটার ওয়ার্কস নির্মাণ করেন।
শ্রীরামপুরের দর্শনীয় স্থান -
সেন্ট ওলাভস চার্চ
শ্রীরামপুরে ডেনিশদের শাসনকালের প্রধান নিদর্শন হল সেন্ট ওলাভস চার্চ । ১৮০৫ সালে ডেনিশ গভর্নর ওলি বী এই ঐতিহাসিক চার্চটি নির্মাণ করেন ।এই চার্চ-এ একসময় এন্টোনি ফিরিঙ্গির মতো ব্যক্তিত্বরাও ভগবানকে আরাধনার জন্য আসতেন ।
গভর্নমেন্ট হাউস -
শ্রীরামপুরের গভর্নমেন্ট হাউসটি তৎকালীন ডেনিশ আমলে নির্মাণ হলেও পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসন এমনকি স্বাধীনতার পর ভারতের নিজস্ব শাসনকালেও এই গভর্নমেন্ট হাউসটি বেশ পরিচিত ছিল । তবে বর্তমানে এটি একটি কালচারাল অফিসে পরিণত হয়েছে। তৎকালীন ডেনিশ রাজত্বের সাক্ষীবহ এই অফিসে প্রায়ই শিল্পকলা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় ।
ডেনমার্ক ট্রাভেন -
গঙ্গা নদীর তীরে ২৩০ বছরের ডেনিশ স্থাপত্যের নিদর্শন হল ডেনমার্ক ট্রাভেন, যা বর্তমানে হুগলি জেলার খাদ্য রসনার একটি নতুন সংযোজন। এখানে ভারতীয় এবং চাইনিজ খাবার ছাড়াও ডেনিশ খাদ্য চেখে দেখার সুযোগ পেয়ে যাবেন। ১৭৮৬ সালে ক্যালকাটা গেজেট অনুসারে জানা যায়, মিস্টার পার, যিনি লন্ডন ট্রাভেন এর মালিক ছিলেন, তিনি এই ডেনমার্ক ট্রাভেন নির্মাণ করেন ।
শ্রীরামপুর কলেজ -
১৮১৮ সালে উইলিয়াম ক্যারি, জাশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড এই কলেজটি নির্মাণ করেন। এই কলেজটি এশিয়ার মহাদেশের দ্বিতীয় প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ভারতের প্রথম মিশনারি কলেজ হিসেবে পরিচিত। মূলত খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেই এই কলেজ নির্মাণ করা হয়। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, এই কলেজে শিক্ষা প্রসারের জন্য ডেনিশ এবং ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছিল। আজও এই কলেজটি নিজের গৌরবকে রক্ষা করে চলেছে । বর্তমানে এই কলেজে খ্রীষ্টান ধর্মতত্ত্ব ছাড়াও বিজ্ঞান, বাণিজ্য এবং কলা বিভাগের পঠনপাঠন হয় ।
শ্রীরামপুর কলেজ দর্শনের পাশাপাশি এই কলেজের লাইব্রেরি, যা ক্যারি লাইব্রেরি নামে পরিচিত, রিসার্চ সেন্টার, এবং ক্যারি মিউজিয়াম পরিদর্শন করতে ভুলবেন না ।
শ্রীরামপুর জননগর ব্যাপিস্ট চার্চ -
শ্রীরামপুর কলেজ পরিদর্শন করে মিনিট পাঁচেক হেঁটে পৌঁছে যান জোহননগর ব্যাপিস্ট চার্চ।১৮০০ শতকে নির্মিত এই চার্চটি উইলিয়াম ক্যারি, মার্শম্যান এবং ওয়ার্ড-এর ভারতে প্রথম বাসস্থান হিসেবে পরিচিত ছিল ।
চাতরার দোল মন্দির -
এই মন্দিরটি ১৫২২ সালে কাশীশ্বর মিশ্র নির্মাণ করেন । এই কাশীশ্বর পন্ডিত শ্রী চৈতন্যদেবের অন্যতম শিষ্য ।ঐতিহ্যবাহী এই মন্দিরে আজও প্রতিদিন রাধা কৃষ্ণের পূজা করা হয় ।
রাধা বল্লব মন্দির -
রাধা বল্লব মন্দিরটি ১৬৭৭ সালে রুদ্র রাম নির্মাণ করেন । মন্দিরটি গঙ্গার পাড়ে নির্মিত হওয়ায় পরিচর্যার অভাবে এবং নদীর ভাঙ্গনের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পরে । পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক শাসন কালে এই মন্দিরের পুনঃনির্মাণ করা হলে হেনরি মার্টিনস পাগোদা নামে পরিচিত পায় ।
মাহেশের জগন্নাথ মন্দির -
প্রাক ঔপনিবেশিক শাসনকালে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেই এই মন্দির গড়ে তোলা হয় । ১৬শ শতকে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী মাহেশে জগন্নাথ মন্দিরের নির্মাণ করেন ।এই মন্দিরে স্থাপিত আছেন ভগবান জগন্নাথ । প্রতিদিন প্রভু জগন্নাথদেবের পূজা ছাড়াও এই মন্দির থেকেই মাহেশের বিখ্যাত রথযাত্ৰা আয়োজন করা হয় । ভারতে পুরীর রথ যাত্রার পর যে রথযাত্রাটি বেশ জনপ্রিয় সেটি হল মাহেশের রথযাত্রা উৎসব ।
কীভাবে যাবেন -
ট্রেনে - হাওড়া থেকে মেইন লাইনের লোকাল ট্রেন চেপে মাত্র ৩০মিনিটের দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে। স্টেশন থেকে টোটো ভাড়া করে শ্রীরামপুরের দর্শনীয় স্থানগুলি পরিদর্শন করে নিতে পারেন ।
সড়কপথে - কলকাতা থেকে গাড়ি চেপে মাত্র ৩১কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেন শ্রীরামপুর।
বঙ্গীয় এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির অসাধারণ মেলবন্ধনের চাক্ষুস পরিদর্শক হতে চাইলে শ্রীরামপুর শহরে আপনাকে স্বাগত ।