বসন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সর্বত্রই রঙের খেলায় মেতে ওঠে । প্রকৃতপক্ষে দোলের সূচনা হয় আগের দিন রাতের বনফায়ার থেকেই । বাঙালি হিসেবে এই বনফায়ার সম্পর্কে আমার ছোটবেলার অভিজ্ঞতা ছিল, সমবয়সী কিছু বন্ধু বান্ধব মিলে দোলের আগের দিনে স্কুল ছুটির পরে বেড়িয়ে কিছু কাঠ ও বিচুলি সংগ্রহ করে যে কোনও আকারে তৈরি করে বনফায়ার করা হত, যাকে বাঙালি ভাষায় নেড়াপোড়া নামে অভিহিত করা হয় । কলকাতা শহরে দোলের আগের দিন বিভিন্ন স্থানে এই নেড়াপোড়া করা হয় ।
কিন্তু হোলির আগের দিন যে এই বনফায়ারের আয়োজন কেন করা, সেই সম্বন্ধে আমরা অনেকেই জানিনা। আচ্ছা বলুন তো, হোলির আগের এই বনফায়ার এর সার্থকতাটা ঠিক কী? প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি বাঙালিরা যে বনফায়ার করে থাকেন তার সঙ্গে হোলিকা দহনের কিছুটা হলেও পার্থক্য আছে । হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী হোলিকা দহনের সঠিক সময় হল পূর্ণিমার রাতে, বাংলায় যে দিনটিতে আমরা সকলে রং খেলি । তবে আপাতদৃষ্টিতে নেড়াপোড়া বা হোলিকা দহনের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভ শক্তির উন্মেষ ।
হোলিকা দহন কী?
হোলির আগের দিন অর্থাৎ পূর্ণিমার রাতে বনফায়ার করে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা। কাঠ অথবা দাহ্য যে কোনও বস্তু এবং পূজার সমস্ত উপকরণের সাহায্যে কোনও মন্দিরের কাছে ফাঁকা জায়গায় যজ্ঞ করাই হল হোলিকা দহন। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী একটি বিশেষ সময়ে সমস্ত রীতি-নীতি মেনে ভগবানের কাছে আহুতি দিয়ে এবং পরিক্রমা করে এই পূজা সম্পাদন করা হয় । শাস্ত্র মতে, হোলিকা দহন প্রতিটি গৃহে সুখ ও শান্তির প্রতীক ।
হোলিকা দহনের পৌরাণিক কাহিনি:
একসময় অন্যান্য অসুর এবং দানবদের মতো রাজা হিরণ্যকশিপুও নিজের অমরত্বের ইচ্ছাপ্রকাশ করেন । সেই সময় সহজে ব্রহ্মার কাছে অমরত্বের বর পাওয়া যেত না; আর তাই নানা কৌশলে ভগবান ব্রহ্মাকে তুষ্ট করার চেষ্টা করেন এবং পরিশেষে তার বর প্রাপ্তি ঘটে ।
ব্রহ্মা প্রদত্ত হিরণ্যকশিপুর বরটি ছিল - কোনও মানুষ বা পশু, গৃহের ভিতরে বা বাইরে, দিনে বা রাত্রে, কোনো অস্ত্র বা শস্ত্র দ্বারা, স্থলে জলে কিংবা আকাশে তাকে হত্যা করতে পারবেন না। এই বরপ্রাপ্তির পর হিরণ্যকশিপু খুবই উদ্ধত হয়ে পড়লেন এবং নিজেকে ভগবান মনে করতে শুরু করলেন । এমনকি রাজ্যের মানুষ যদি তার আদেশ অমান্য করেন তাহলে তাকে তৎক্ষণাৎ হত্যাদেশ দিতেন । হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ মানুষের উপর তার পিতার এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পিতাকে ভগবান রূপে আরাধনা করতেও প্রত্যাখ্যান করেন। প্রহ্লাদ বরাবরই ভগবান বিষ্ণুর পূজারী ছিলেন ।
এই ঘটনায় হিরণ্যকাশিপু তাঁর পুত্র প্রহ্লাদের উপর রেগে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন । এই হত্যাকাণ্ডের জন্য হিরণ্যকশিপু তার বোন হোলিকার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। হোলিকার এক বিশেষ পরিধান ছিল যা আগুনে পোড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে । হিরণ্যকশিপু একসময় হোলিকাকে বলেন প্রহ্লাদকে সঙ্গে নিয়ে অগ্নিকুণ্ডে বসতে। তখন প্রহ্লাদ ছল করে হোলিকার কোলে বসে পড়েন এবং অগ্নি প্রজ্জলিত হলে দেখা যায় হোলিকার সেই বিশেষ পরিধান প্রহ্লাদকেই আবৃত করে থাকে এবং হোলিকা মারা যান ।
এরপর বিষ্ণুর নরসিংহ অবতারে আবির্ভাব ঘটে, তিনি হিরণ্যকাশিপুকে প্রবেশদ্বারে নিয়ে গিয়ে নিজের কোলে উপরে সন্ধেবেলা সিংহের নখ দিয়ে রাজাকে হত্যা করেন । এক্ষেত্রে হিরণ্যকাশিপুর বরটি কার্যকরী হতে পারে না । এরপর প্রহ্লাদের রাজত্বে প্রজারা স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হোলির আগের দিন রাতে দুষ্টকে দমন করেই শুভ শক্তির বিকাশ ঘটে ।
ভারতের হোলিকা দহনের উৎসস্থল:
বর্তমানে ভারতের প্রায় সমগ্র অঞ্চল জুড়েই হোলিকা দহন উদযাপন করা হলেও, এই উৎসবের মূল উৎসস্থল হলো উত্তর ভারতীয় স্থানগুলি । এখানে হিন্দু শাস্ত্রের সমস্ত উপদেশ এবং আচার মেনেই এই উৎসব পালিত হয় । যেহেতু ভারতে গরুকে মা বলে মানা হয়, তাই এই বনফায়ারে গোবর আহুতি দেওয়া হয়, কারণ মানুষের বিশ্বাস এই আহুতির সাহায্যে যা কিছু খারাপ তা সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হবে।হোলিকার এই প্রথাটি গুজরাট এবং ওড়িশাতেও মান্য করা হয়। বিভিন্ন রকম দাহ্য বস্তু ছাড়াও যজ্ঞাগ্নিতে চাষের সামগ্রীও আহুতি দেওয়া হয় ।
রাজস্থানের উদয়পুরে হোলিকা দহনের বিশেষত্ব:
রাজস্থানের উদয়পুরে এই হোলিকা দহন উৎসবটি সাড়ম্বরের সঙ্গে পালন করা হয় । ভারতের অন্যান্য স্থান যখন শুধুমাত্র রঙের উন্মাদনায় জেগে ওঠে, তখন রাজস্থানের এই শহরটি নেতিবাচকতা দূরীকরণের প্রচেষ্টায় উন্মুখ থাকে । উদয়পুরের সিটি প্যালেসে পূর্ণিমার রাতে স্থানীয় মানুষ একত্রে পৌরাণিক কাহিনীকে স্মরণে রেখেই হোলিকা দহন করেন । প্রাচীন প্রথা অনুসারেই উদয়পুরের রাজপরিবার তাদের মেওয়ার বংশের গৌরব অক্ষুন্নতা রক্ষার উদ্দেশ্যেই এই উৎসব পালন করেন । এই দিনে রাজপরিবারের সমস্ত সদস্য তাদের কর্মীবৃন্দ সহযোগে রাজস্থানের নির্দিষ্ট পোশাক পরিধান করে ঘোড়ার পিঠে চেপে গান বাজনা সহকারে রাজবাড়ি থেকে মানেক চৌক পর্যন্ত একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকেন ।
এছাড়াও হোলিকা দহনের সম্মুখে স্থানীয় মানুষরা রাজস্থানের লোকসঙ্গীতের মাধ্যমে নৃত্যপ্রদর্শন করে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন।
সিটি প্যালেসে এই হোলিকা উৎসব প্রায় ১সপ্তাহ ধরে পালন করা হয় । এই উৎসবে সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী যেমন ক্লাসিকাল মিউজিক অনুষ্ঠান, লোকনৃত্য, পৌরাণিক কাহিনিকে কেন্দ্র করে যাত্রাপালা, ইত্যাদির আয়োজন করা হয় । এক কথায় এই উৎসবটি রাজকীয়তা এবং ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির পরিপূরক ।
রাজস্থানের এই হোলিকা উৎসবের সাক্ষী থাকতে পারেন আপনিও ।
সিটি প্যালেসের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান:
সিটি প্যালেসের ঐতিহ্যবাহী উৎসব হোলিকা দর্শনের সঙ্গে সঙ্গেই দর্শন করে নিতে পারেন অমর ভিলা, বাদী মহল, ভীম ভিলা, চিনি চিত্রশালা, ছোটি চিত্রশালা, দিলাখুশা মহল, দুর্বার হল, ফতেহ প্রকাশ প্যালেস, কৃষ্ণ ভিলা ইত্যাদি ।
কীভাবে পৌঁছবেন উদয়পুর সিটি প্যালেস:
বিমানে - কলকাতা বিমানবন্দর থেকে উদয়পুর পৌঁছনোর জন্য বেশ কয়েকটি বিমান উপলব্ধ আছে । বিমানবন্দর থেকে গাড়ি করে পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে।
ট্রেনে - কলকাতা স্টেশন থেকে উদয়পুর স্পেশাল ট্রেনে চেপে পৌঁছে যেতে পারেন উদয়পুর । স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে ৫কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যান সিটি প্যালেস ।