বাংলা সাহিত্য জগতে অসামান্য কিছু সাহিত্য নিদর্শনের অন্যতম স্রষ্টা হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কলমের ছোঁয়ায় বাংলায় সৃষ্ট প্রতিটি উপন্যাস, প্রবন্ধগ্রন্থ হয়ে উঠেছে এক অন্যতম সাহিত্যসৃষ্টির নিদর্শন। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সাহিত্যের সুপণ্ডিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পাণ্ডিত্য, সহনশীলতা ও গভীরতার উপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর প্রবন্ধগুলিতেও। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ধ্রুপদী শিল্পী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজের অন্যতম শাসনকর্তা হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৮২ সালে তাঁর রচিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের কবিতা ‘বন্দে মাতরম’ ১৯৩৭ সালের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক ভারতের জাতীয় স্তোত্র হিসেবে মর্যাদা পায়।
জন্ম ও মৃত্যু দিবস:-
১৮৩৮ সালের ২৬শে জুন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নৈহাটির শহরে কাঁঠালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
১৮৯৪ সালের ৮ই এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলা সাহিত্যে তাঁর সৃষ্টির অবদান:-
বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ রচনার পর একে একে ‘কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ, চন্দ্রশেখর, কৃষ্ণকান্তের উইল, দেবী চৌধুরানী’-র মতো বিখ্যাত কিছু উপন্যাসের জন্ম হয় তাঁর হাত ধরে। এছাড়াও তিনি কিছু প্রবন্ধগ্রন্থ যেমন- কমলাকান্তের দপ্তর, কৃষ্ণ চরিত্র, বিবিধ প্রবন্ধ প্রভৃতি রচনা করেন।
বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মভিটে পরিদর্শন:-
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শৈশব জীবনের কিছু ইতিহাস এবং তাঁর জন্ম বৃত্তান্ত ঘেটে দেখার জন্য এবার আমাদের গন্তব্যস্থান হল নৈহাটির কাঁঠালপাড়া।
কীভাবে যাবেন:-
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে নৈহাটি স্টেশনে এসে পৌঁছতে হবে। তারপর নৈহাটি স্টেশনে নেমে হাঁটা পথে কিংবা রিক্সা করে কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্রের এই জন্ম ভিটেতে পৌঁছতে পারেন।
কখন যাবেন:-
প্রবল ব্যস্ততার মধ্যে যদি মাত্র কয়েক ঘণ্টার ছুটির আয়োজন আপনি করতে পারেন, তাহলে বছরের যেকোনো সময় যে কোনও দিন এই জায়গা থেকে ঘুরে আসতে পারবেন।
জায়গাটির বর্ণনা:-
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরে অবস্থিত কাঁঠালপাড়ার যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও দুর্গাসুন্দরী দেবীর তৃতীয় পুত্র হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই কাঁঠালপাড়ার বাড়িতে বঙ্কিমচন্দ্রের বাল্য, কৈশোর এবং যৌবনকাল কাটে। শুধু তাই নয়, এই বাড়িতে আরও একজন গুণী সাহিত্যিকের জন্ম হয়। তিনি হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মেজদা সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। যাঁর রচিত বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনি ‘পালামৌ’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের এক অনবদ্য সৃষ্টি।
পাঁচ বছর বয়সে চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারের কুলপুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতেখড়ি হয়। এরপর তিনি গ্রামের পাঠশালায় পড়বার অনিচ্ছা প্রকাশ করলে, পাঠশালার গুরুমহাশয় রামপ্রাণ সরকার তাঁকে বাড়ি এসে শিক্ষাদান করেন। তবে শৈশবেই তাঁর সাহিত্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ধরা দেয়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বসত বাড়ির বিবরণ:-
বসত বাড়িটির উত্তর-পশ্চিম অংশে রয়েছে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পারিবারিক আঁতুড়ঘর। যেখানে একটি স্মারকের মধ্যে লেখা আছে কোন সালে কে কখন জন্মগ্রহণ করেছেন। এরপর অন্দরমহলে প্রবেশ করলে এই বাড়ির প্রধান আকর্ষণীয় কেন্দ্রবিন্দু দোতলায় অবস্থিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শয়নকক্ষটি দেখা যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যবহৃত কাঠের খাট, আলমারি প্রিয় দেওয়াল ঘড়ি, উনার দ্বিতীয় স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দেবী সঙ্গে ওনার ছবিতে এখনও সুসজ্জিত ওই কক্ষটি। আসবাবপত্রগুলির দিকে তাকালে কেমন যেন পুরনো দিনের সেই সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।বসত বাড়ির দক্ষিণ দিকে রয়েছে বৈঠকখানা, যেখানে সেইসময় বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে বসত বঙ্গদর্শনের মজলিস। বলা ভাল, সাহিত্যের আড্ডা।
এই আড্ডায় উপস্থিত থাকতেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, নবীনচন্দ্র সেন, দীনবন্ধু মিত্র, অক্ষয় কুমার সরকারের মত ব্যক্তিবর্গরা। বৈঠকখানার পাশেই রয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখার ঘর, যেখানে প্রবেশ করলে দেখা যায় সাহিত্য সম্রাট-এর লেখা নানা পুঁথিপত্র। রয়েছে একটি কাঠের টেবিল ও চেয়ার, যেটির উপরে বসে তিনি এইসব অমর সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। এই ঠিক পাশেই রয়েছে চট্টোপাধ্যায় বাড়ির পারিবারিক কুলদেবতার মন্দির এবং শিব মন্দির।
বর্তমানে এই স্থানটি সরকারি অধিগ্রহণের ফলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমস্ত পুঁথিপত্র নিয়ে একটি সংগ্রহশালা এবং গবেষণাগার নির্মাণ করা হয়েছে, যার অন্দরমহলে রয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ব্যবহৃত পাগড়ী, শাল, সাঁঝবাতি, দাবার গুটি, গানের স্বরলিপির খাতা, বংশতালিকা এবং অভিজ্ঞান শকুন্তলম-এর পুঁথি, বঙ্গদর্শন পত্রিকার অর্থের বাক্স ইত্যাদি।
আকর্ষণীয় বিষয়:-
• জন্মের পর প্রথম ছয় বছর তিনি এই কাঁঠাল পাড়ার বাড়িতেই কাটিয়েছেন পরবর্তীতে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও তিনি এই স্থানটিকে নির্বাচন করেছিলেন।
• ১৮৭২ সালের কাঁঠালপাড়া এই বাড়ি থেকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উদ্যোগে প্রথম মাসিক পত্রিকা ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশিত হয়।
• প্রথম তিন বছর তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
• এইখানকার গ্রন্থাগারে শুধু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখা পুস্তকই নয়, রয়েছে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখা বিভিন্ন সাহিত্য গ্রন্থ।
• বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা বঙ্কিম রচনাবলী সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ভাষায় সেটির অনুবাদ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এই গবেষণাগার থেকেই।
শুধু সাহিত্যপ্রেমী হওয়ার সুবাদে নয় বিখ্যাত এই সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিকের সম্বন্ধে আরও বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে এবং তাঁর জীবনের অজানা কিছু পর্বকে নিজের জানার আগ্রহ তালিকায় যোগ করতে একবার কিছুটা সময় হাতে নিয়ে ঘুরে আসতেই পারেন নৈহাটির এই কাঁঠালপাড়ায়। শুধু বাংলা ভাষার সঙ্গে বাঙালির মাতৃত্বের টান নয়, এখানে গেলে অনুভব করবেন সাহিত্যের সঙ্গে সাহিত্যপ্রেমীদের এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন।