হিন্দু সংস্কৃতির প্রধান দেবতা হলেন শক্তি এবং শিব । তবে শিব নির্দিষ্ট রূপে পূজিত হলেও শক্তি বিভিন্নরূপে বিরাজিত এবং পূজিত হন। আর এই ঝাড়খণ্ডের রাজারাপ্পা মন্দিরে শক্তির অর্থাৎ মা কালীর রূপ হিসেবে মস্তকহীন দেবী ছিন্নমস্তার আরাধনা করা হয়। এই রাজারাপ্পা মন্দির ভারতের শক্তিপীঠ গুলির মধ্যে অন্যতম।
রাজারাপ্পা মন্দিরটি দামোদর এবং ভৈরবী নদীর সংযোগস্থলের ঝাড়খণ্ডের রামগড় জেলায় অবস্থিত ।
কে এই দেবী ছিন্নমস্তা?
হিন্দু শাস্ত্রে ১০টি মহাবিদ্যার উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ দেবী পার্বতীর ১০টি রূপের মধ্যে অন্যতম হলেন দেবী ছিন্নমস্তা । তন্ত্র সাধনার জন্য যে প্রচণ্ড চণ্ডীকা দেবীকে আরাধনা করা হয় তিনিই হলেন দেবী ছিন্নমস্তা । বসনহীন এই দেবী গলায় রয়েছে মুণ্ডমালা, দেবীর পায়ের নিচে পদ্ম ফুলের উপর বিপরীত ক্রিয়ায় অধিষ্ঠিত আছেন কাম এবং রতি। ডান হাতে রয়েছে রক্তমাখা খড়্গ এবং বাম হাতে তিনি ধারণ করে আছেন স্বয়ং দেবীর কাটা মস্তক। গলা থেকে নির্গত রক্তস্রোত তিন ভাগে বিভক্ত, আর তা পান করছেন দেবীর দুই সঙ্গী ডাকিনি শাকিনি এবং দেবী নিজে। দেবী ছিন্নমস্তা অসংগতির দেবী হিসেবে পরিচিত, তিনি যেমন প্রাণদায়ী তেমনি প্রাণহারীও।
দেবী ছিন্নমস্তার পৌরাণিক কাহিনি
এই পৌরাণিক কাহিনী ঘিরে বহু মতভেদ রয়েছে, তবে রাজারাপ্পা মন্দিরের দেবী ছিন্নমস্তার সবচেয়ে প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনীটি হল নিম্নরূপ।
একদা দেবী ভবানী তার দুই সঙ্গী ডাকিনি এবং শাকিনিকে নিয়ে মন্দাকিনী নদীতে স্নান করতে গিয়েছিলেন। স্নান করতে করতে দেবীর সঙ্গীরা ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েন এবং দেবীর কাছে খাদ্যের জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু দেবী তাদের আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু ক্ষুধায় সঙ্গীদের প্রাণ অষ্ঠাগত হয়ে পড়ে; তখন সঙ্গীরা দেবীকে বলেন ‘যখন কোনও সন্তান ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে তখন মা তার সমস্ত কাজ ভুলে সন্তানকে খাদ্য পরিবেশন করেন। আপনিও তো মা, তাহলে আপনি কেন আমাদের ক্ষুধা মেটাচ্ছেন না?'
তখন দেবী খড়্গ এর সাহায্যে নিজের মাথা কেটে ফেলেন আর সেই রক্তের ধারা কে তিনভাগে বিভক্ত করেন। রক্তের দুই ধারা দেবী তার সঙ্গীদের দিকে প্রবাহিত করেন এবং তৃতীয় ধারা থেকে নিজের ক্ষুধা মেটান। এই ঘটনা থেকেই দেবীর এই রূপ ছিন্নমস্তা নামে পরিচিত এবং রাজারাপ্পা মন্দিরে দেবী এই রূপেই বিরাজমান আছেন ।
রাজারাপ্পা মন্দির সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য
স্থানীয় বিশ্বাস অনুসারে, এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল মহাভারতীয় সময়কালে। তবে সেই প্রাচীন মন্দিরটি ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে আবার নতুন কলেবরে মন্দিরটিকে নির্মাণ করা হয় । কিন্ত দেবী মূর্তি প্রাচীন সময়কাল থেকে আজও স্বমহিমায় স্থাপিত আছেন। এই মন্দিরের প্রধান তোরণদ্বার পূর্বমুখী। যেহেতু আসামের পর এই মন্দিরটি তন্ত্র সাধনার অন্যতম পীঠস্থান, তাই এই বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণের সময়ে তান্ত্রিক শৈলীকে স্মরণে রেখেই তৈরি করা হয়েছে।
এই মন্দিরের সামনে বেশ খানিকটা প্রশস্ত অঞ্চল রয়েছে বলিদানের জন্য। এখানে প্রতিদিন ১০০০-২০০০ ছাগ বলি করা হত। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, প্রতিদিন এতগুলো বলি হওয়ার পরও এখানে একটাও মাছি দেখতে পাওয়া যায় না। এছাড়াও দর্শণার্থীরা নিজেদের মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য লাল কাপড়ে পাথর জড়িয়ে মনোকামনা শিলাখণ্ডে বেঁধে রাখেন এবং সেই ইচ্ছা পূরণ হলে সেই পাথর দামোদর নদে ভাসিয়ে দেন।
মন্দিরের চার প্রান্তে চারটি কুণ্ড আছে। তবে কথিত আছে, পাপহারিণী কুণ্ডতে স্নান করলে যে কোনও রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। উপরিউক্ত ঘটনাগুলি অলৌকিক মনে হলেও স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, এখানে দেবী ছিন্নমস্তা খুবই জাগ্রত ।
এখানে প্রতি মঙ্গলবার এবং শনিবার বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়। এছাড়াও অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে সারারাত পূজা করা হয় এবং এই দিনে তন্ত্র সাধনার দ্বারা সাধুদের সিদ্ধিপ্রাপ্তিও ঘটে থাকে। এই মন্দিরে নবরাত্রিতেও বিশেষ পূজার আয়োজন হয়। হিন্দু ভক্তরা যে কোনও শুভ কাজ এমনকি বিবাহের জন্যও এই মন্দিরকে বেছে নেন।
এছাড়াও সাঁওতালরা তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর পর দামোদর নদে অস্থি ভাসিয়ে, মন্দিরে পূজা সম্পাদন করে তাদের প্রিয়জনের শান্তি কামনা করেন। মকরসংক্রান্তির দিনে এই মন্দিরের পূজাকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজনও করা হয়।
কী কী করবেন?
১. দেবী ছিন্নমস্তার পুজো দিয়ে নিজের মনের ইচ্ছা দেবীকে জানিয়ে আসতে পারেন।
২. মন্দিরের পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক শোভা কিন্তু আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
৩. নৌকাবিহার করে পরিদর্শন করে আসতে আসুন দামোদর এবং ভৈরবী নদীর মিলন স্থল। কথিত আছে, রাজারাপ্পা মন্দিরে যেহেতু কাম এবং রতি বিপরীত ক্রিয়ায় অধিষ্ঠিত আছেন, তাই প্রকৃতির ক্ষেত্রেও দামোদর নদ এবং ভৈরবী নদীরও বিপরীত ভাবে সংযোগ ঘটেছে।
৪. দামোদর ও ভৈরবী নদীর সংযোগস্থলে একটি জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে। নৌকাবিহার করে গেলে এই প্রবাহমান জলপ্রপাতও চাক্ষুষ করে আসতে পারেন।
৫. চারিদিকে পাহাড়ে মোড়া প্রবাহমান নদীর সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে এই দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দি করতে কিন্তু ভুলবেন না ।
চলচ্চিত্র জগতে দেবী ছিন্নমস্তার ভূমিকা
প্রখ্যাত লেখক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় বাঙালির আবেগের গোয়েন্দা "ফেলু মিত্তির" বা "ফেলুদা"-কে নিয়ে ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ নামক একটি গল্প লেখেন, যেটিকে পরবর্তীকালে তিনি ফিল্মের রূপ দেন। রাজারাপ্পা মন্দিরের প্রেক্ষাপটই ছিল এই ছবির মূল বিষয়বস্তু। গোয়েন্দা কাহিনি বিশেষত ফেলুদা যারা ভালোবাসেন, তারা নিশ্চয়ই জানবেন কীভাবে ফেলুদা মহেশবাবুর মৃত্যুর রহস্য কিনারা করেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে মনুষ্য চরিত্রের ষড়রিপু অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য মানুষের জীবন অসহ করে তোলে। আর গল্পের চরিত্র মহেশবাবুর জীবনে দ্বিতীয় এবং পঞ্চম রিপু অর্থাৎ ক্রোধ আর মদ অভিশাপ হিসেবে হয়ে দাঁড়ায়; যেটিকে গল্পে "ছিন্নমস্তার অভিশাপ" হিসেবে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। অল্প বয়সে এই দুই রিপুর বশে তিনি দারোয়ান দীনদয়ালকে হত্যা করেন। পরবর্তী কালে প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করলেও তিনি অভিশাপ মুক্ত হতে পারেন না। আর, এই অভিশাপই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দেখা দেয়।
পরিশেষে এইটুকু বলা যায়, তান্ত্রিক দেবী ছিন্নমস্তা ভয়ঙ্করী দেবী হিসেবে পূজিত হলেও ইনি ভক্তদের মনের সমস্ত ইচ্ছা পূরণ করেন। পুরাণ অনুযায়ী একসময় রাক্ষসদের নিধনের জন্য সমস্ত দেবতারা মিলে কালীমাতাকে সৃষ্টি করেছিলেন। সেই ধারণাকে কেন্দ্র করেই আবির্ভাব হয় দেবী ছিন্নমস্তার।
কখন যাবেন
বছরের যে কোনও সময় দেবীর দর্শন করতে পারেন। তবে দেবী দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে নৈসর্গিক প্রকৃতিকে উপলব্ধি করতে চাইলে অক্টোবর থেকে মার্চ মাস সময়টিকে বেছে নিতে পারেন।
কীভাবে যাবেন
বিমানে - ভারতের যে কোনও বিমানবন্দর থেকে পৌঁছে যেতে পারেন রাঁচির বিরসা মুন্ডা বিমানবন্দর। বিমানবন্দর থেকে গাড়ি ভাড়া করে মাত্র ৭৩ কিমি রাস্তা অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে।
ট্রেনে - হাওড়া রাঁচি ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ধরে পৌঁছে যেতে পারেন রামগড় ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন। স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে যেতে পারেন রাজারাপ্পা মন্দির।
সড়কপথে - গাড়ি সহযোগে কলকাতা থেকে আসানসোল-ধানবাদ হয়ে ৩৭০ কিমি পথ অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেন রাজারাপ্পা মন্দির ।