দেখুন, বাঙালিরা কিন্তু মাঝেমধ্যেই ঘুরতে যান; কেউ যান দীঘা পুরী দার্জিলিং, আবার কেউ শিমলা কুলু মানালি। তবে এইসব ডেস্টিনেশগুলো বাদেও কিন্তু বাঙালি মাঝে মধ্যেই ঘুরে আসে আর্সলান, আমিনিয়া, বা রয়্যাল থেকে। ঠিক ধরেছেন, বিরিয়ানির নেশা কিন্তু আমাদের মধ্যে ষোলো আনা। ছোট বেলা থেকেই কিন্তু আমাদের বাইরে খাওয়ার হাতেখড়িও বলতে গেলে এই বিরিয়ানির হাত ধরেই।
তবে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার নজরে পড়ে। যারা যারা আমরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় গেছি, সেখানের বিরিয়ানি খেয়ে কিন্তু বেশ আশাহত হয়েছি। বুঝতে পেরেছি যে কলকাতার বিরিয়ানির জায়গা কিন্তু হায়দ্রাবাদের বা লখনৌয়ের বিরিয়ানি দখল করতে পারবে না। আর শুধু স্বাদের দিক থেকেই নয়, কলকাতার বাইরের বিরিয়ানির গঠন বিন্যাসেও কিন্তু আমরা দেখতে পাই মহাপাপ - আমাদের সাধের বিরিয়ানির আলুর এক টুকরোও আর কোথাও পাওয়া যায় না!
একটু তুলনামূলক বিচার করলেই আমরা দেখতে পাব কলকাতা বিরিয়ানি কেন এতটা আলাদা, আর কেন এতটা জনপ্রিয়। কলকাতা বিরিয়ানিতে অপ্রয়োজনীয় মশলার কোন আধিক্য থাকে না, ফলে স্বাদ যতটুকু আসে তা একেবারে খাঁটি এবং মনে রাখার মতো। মশলা কম থাকায় বেশি গুরুপাক নয়, অতএব ব্যাপারটি বেশ সহজপাচ্য। কেরালা, হায়দ্রাবাদের ঝাল মশলাদার বিরিয়ানিতে স্বাদের এই সুক্ষ্মতা বা মাহাত্ম্য, কোনওটাই নেই।
আর কলকাতা বিরিয়ানির নরম তুলতুলে আলুর তো কোনও তুলনাই নেই। অনেকক্ষণ ধরে বিরিয়ানির সাথে রান্না হওয়া কোমল আলু, যার ওপর চামচ রাখলে মাখনের মতো কেটে যায়, এই জিনিস আর কোথায় পাবেন। কলকাতায় বিরিয়ানিতে আলুর আগমনের পিছনে কারণ খুঁজতে গেলে কিন্তু যেটা সকলেই বলে থাকে তা হল বিরিয়ানি তে দামি মাংসের বদলে কমদামি আলু দিয়ে খরচা বাঁচানোর প্রয়াস থেকেই এই ধরনের বিরিয়ানির উৎপত্তি, যা দেশের অন্যান্য বিরিয়ানি থেকে হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র। স্বাদের স্বাদ ও রইল, বেশ কিছুটা খরচও বেঁচে গেল।
তবে আসল গল্পটা কিন্তু অন্য। খরচ খরচা বাঁচানোর জন্যে বিরিয়ানিতে আলু দেওয়ার গল্প রটনা করেছিলেন তৎকালীন ইংরেজ সরকারের প্রতিনিধিরা। কারণ? ইংরেজদের দ্বারা নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ-র মানহানি করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা। তাহলে আসলে কি হয়েছিল? আসুন, জেনে নি সত্যি ঘটনাটুকু।
কলকাতা শহরে নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ-র আগমন ঘটে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে। প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন কিভাবে আওয়াধের হৃত সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়া যায়। কিন্তু রানী ভিক্টরিয়ার সঙ্গে এই নিয়ে ভাল করে কথা বলতে পারার আগেই দেশে শুরু হল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ। সুযোগ বুঝে ইংরেজ সরকার নবাবকে প্রায় দুই বছর বন্ধ করে রাখে ফোর্ট উইলিয়ামের কুঠুরিতে। দুই বছর পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার সময় ভারতবর্ষের যে কোনও স্থানে নতুন করে বসবাস করতে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। নবাব বেছে নেন কলকাতার মেটিয়াবুরুজ। অল্পকিছুদিনের মধ্যেই যেন মেটিয়াবুরুজ পরিণত হয় আওয়াধি লখনৌয়ের এক ক্ষুদ্র সংস্করণে। কারণ মেটিয়াবুরুজে নবাবের আসার কথা শুনে আসতে আসতে চলে এসেছে নবাবের রাজসভার সঙ্গীতশিল্পী, হাকিম-বৈদ্য, পাচক সবাই। আর সেই পাচকদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল কলকাতা বিরিয়ানির এই পরিচিত রূপে পথ চলার।
আওয়াধের সম্রাটরা ছিলেন খাদ্যরসিক, তাঁদের শেফ-দের অন্যতম কাজ ছিল নিত্য নতুন গবেষণা চালিয়ে নতুন নতুন খাবার তৈরি। এই কাজে তাদের সুখ্যাতি ছিল অপরিসীম। আবার এই সময়ের আশেপাশেই ভারতবর্ষে পর্তুগিজদের হাত ধরে আগমন হয় আলু, লঙ্কা এবং টমেটোর।
সুরাটে ফলানো সেই আলু ব্রিটিশ বণিকদের হাত ধরে পা রাখে বাংলায়। তখন কিন্তু আলু বাঙালির প্রাণপ্রিয় নিত্যনৈমিত্তিক সঙ্গী নয়, বরং তখন আলু হয়ে উঠেছিল বিদেশি, বহুমূল্য, শখের এক ফসল।
অনুমান করা হয় যে নবাবের পাচকরাই খাবার নিয়ে নানান রকম এক্সপেরিমেন্ট করতে করতে বিরিয়ানিতে প্রথম আলু দিয়ে রান্না শুরু করে। ঢিমে তালে দমের উপরে রাঁধা সেই নবাবী বিরিয়ানিতে পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ে নতুন আলুর ভালোবাসা। মুগ্ধ হয়ে পড়েন নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ - ফরমান দেন এরপর থেকে যখনই বিরিয়ানি রান্না হবে, তাতে যেন থাকে নরম এক টুকরো আলু।
কলকাতা বিরিয়ানির ইতিহাসের সঙ্গে কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে জড়িয়ে রয়েছে ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্র। নানা ভাবে ভারতের রাজা আর নবাবদের দুর্নাম করা, তাদের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ানো ছিল তাদের রোজকার কাজ। তাঁদের মুখেই শুরু হয় এই গুজব যে নবাব টাকার অভাবে মাংসের বদলে বিরিয়ানিতে আলু দিচ্ছেন। যদিও একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই জানা যাবে যে মেটিয়াবুরুজে থাকাকালীন তাঁর জন্যে ইংরেজ সরকার খোরপোষ হিসাবে বরাদ্দ করেছিল বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা, আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগে।
তাই কলকাতা বিরিয়ানির এই দুর্নাম আর আমরা সহ্য করব না। বিরিয়ানিতে আলু এসেছে আলুর নিজস্ব স্বাদ আর মহিমার গুনেই। তাই জেনে রাখুন বিরিয়ানির ইতিহাসের আসল সত্যি, আর কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার সময় আপনার পাতে পড়ুক সোনালী মখমলী এক টুকরো আলু।