বিশ্বের সর্বত্র ১৮ই এপ্রিল দিনটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ডে হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনটি সেলিব্রেট করার জন্য চলুন ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্পকলা ও জীবনযাপনকে আরও একবার পুনরুজ্জীবিত করে তোলা যাক। ভারতে এমন অনেক স্থান বা স্মৃতিসৌধ আছে যা আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে, এইগুলোই ‘হেরিটেজ’ নামে পরিচিত । এই ধরণের সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহ্যবাহী হেরিটেজ স্থান ভ্রমণ করতে চাইলে পৌঁছে যেতে পারেন ওড়িশা।
ভারতের এই হেরিটেজ প্রপার্টিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কিন্তু সমানভাবে আমাদের ওপরেও বর্তায়। আমরা যদি সমস্ত ভারতবাসী একত্রে এই সম্পদগুলি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিই, তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্মও এর সাক্ষী থাকতে পারবে এবং ঐতিহ্যবাহী ভারত সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট জ্ঞান লাভ করতে পারবে ।
ওড়িশার বৌদ্ধ পরিক্রমা
ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ডে উপলক্ষে টিম #FOTW ওড়িশার শতাব্দী প্রাচীন বৌদ্ধ অঞ্চল রত্নগিরি, উদয়গিরি, ললিতগিরি পরিদর্শন করার প্ল্যান করে থাকেন।
এখানে রয়েছে কিছু প্রাচীন স্তূপ, মনেস্ট্রি ও তার ধ্বংসাবশেষ, আর রয়েছে কিছু মূল্যবান ভাস্কর্য। আমরা সকলেই জানি ওড়িশা রাজ্যটি ভারতীয় সংস্কৃতির মূল পীঠস্থানগুলির মধ্যে অন্যতম ।
তবে ওড়িশা ভ্রমণে এলেও অনেকের কাছেই এই বিশেষ স্থানগুলি অজানা। এই স্থানটির খননকার্য ১৯৬০ সালে শুরু হলেও সম্পূর্ণ বৌদ্ধ অঞ্চলের খননকার্য সম্পন্ন হয় ২০০০ সালের শুরুর দিকে। এই খননকার্যটি আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া দ্বারা পরিচালিত হয়। এই খননের পর ASI নিশ্চিত করেছেন এই অঞ্চলটি প্রায় পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শতক প্রাচীন, সুতরাং বলাই বাহুল্য, এই অঞ্চলটি অবশ্যই ঐতিহ্যমণ্ডিত।
খননের পর এই অঞ্চল থেকে অনেক পাথরের ভাস্কর্য, কিছু ব্রোঞ্চ এবং পিতলের বৌদ্ধ ছবি পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও সম্পূর্ণ খননকার্য রেকর্ডিং করে জানা যায় বিহারের নালন্দার থেকেও বড়ো ‘তন্ত্রসাধনা কেন্দ্র' হিসেবে পরিচিত ছিল রত্নগিরি। খননের ফলে এখানে একটি মাটির ছাদেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘শ্রী রত্নগিরি মহাবিহারিয়া আর্য ভিক্ষু সমঘ্য'-এর মতে, সেই সময় এখানে মনেস্ট্রি এবং সাধুদের অস্তিত্ব ছিল।
রত্নগিরির প্রবেশপথ -
এই প্রবেশপথে একটা বিশাল বাগান রয়েছে এবং সম্মুখ প্রান্তে রয়েছে প্রাচীন এবং প্রকাণ্ড একটি বটগাছ; যা দেখলে মনের মধ্যে অদ্ভুত শান্তি খুঁজে পাবেন। ইচ্ছা করলে বট গাছের নিচে বসে একটু ক্লান্তি কাটিয়ে নিতে পারেন। এছাড়াও ভারতের এই প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান দর্শন আপনাকে মোহিত করবেই।
প্রকৃতপক্ষে, রত্নগিরি হল পাহাড়ের উপরে একটি সমতল অঞ্চল । এখানে প্রধান স্তূপকে কেন্দ্র করে রয়েছে বেশ কয়েকটি ধ্বংসস্তূপ। এছাড়াও কয়েকটি স্তূপ, ২টো মনেস্ট্রির অর্ধভগ্ন স্তূপও রয়েছে। যদিও খনন কার্যের ফলে যা পাওয়া গিয়েছে তার বেশিরভাগ অংশই ধ্বংসস্তূপ, তবে প্রধান মনেস্ট্রি কমপ্লেক্সটি বর্তমানে যথাযথভাবে সংরক্ষিত আছে। এখানকার মনেস্ট্রিটি সবুজ ক্লোরাইট পাথরের দ্বারা সুসজ্জিত আঙ্গিকে নির্মিত। এই সংরক্ষণের ফলস্বরূপ তৎকালীন ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করে সকল পর্যটকগণ উদ্ভুদ্ধ হন।
দ্বিতীয় দিন –
বর্তমানে এই মনেস্ট্রির প্রধান কমপ্লেক্স ছাড়াও মনেস্ট্রির একটি বিশাল উন্মুক্ত প্রাঙ্গন, পাথরের বৌদ্ধ মূর্তি, এবং তৎকালীন শিল্পকলা লক্ষ করা যায় ।
এখান থেকে এই অঞ্চলের একটা সুন্দর দৃশ্যও প্রত্যক্ষ করা যায় । তবে এখানকার শান্ত সিন্গ্ধ পরিবেশ দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, কেন সেই সময় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীগণ এই অঞ্চলটিকে বেছে নিয়েছিলেন।
এই অঞ্চলটি প্রদক্ষিণ করতে করতে হঠাৎই আমার মনে হল মাটির নিচে নিশ্চয়ই এখনও অনেক রত্নভাণ্ডার রয়েছে। কৌতূহল বসেই প্রায় ১০মিনিট মাটি খুঁড়ে পেয়ে গেলাম বুদ্ধমূর্তির কিছু ভগ্নস্তূপ এবং বলাই বাহুল্য, সমস্ত ভ্রমণের এই অভিজ্ঞতাটা আমাকে বেশ উত্তেজিত করে তুলেছিল। আমার মনে হয়, এখনও খনন করলে ৬ থেকে ১৩ শ শতকের বেশ কিছু জিনিস খুঁজে পাওয়া যাবে।
এরপর পৌঁছে গেলাম ASI পরিচালিত রত্নগিরির আর্কিওলজিকাল মিউজিয়ামে। এখানে মোট ৪ টি গ্যালারিতে রয়েছে খননকার্যের ফলে পাওয়া ৫ম থেকে ১৩শ শতকের পাথর এবং ব্রোঞ্জের বেশ কিছু মূর্তি, বিশেষত প্রাচীন কিছু বৌদ্ধমূর্তি। শেষ গ্যালারিতে রয়েছে বেশ কিছু হাতির দাঁত দ্বারা নির্মিত জিনিস, তামার থালা বাসন এবং কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এই গ্যালারিতে কিন্তু ফটো তোলা একেবারেই নিষিদ্ধ ।
রত্নগিরি থেকে প্রায় ৯কিমি দূরে পৌঁছে গেলাম উদয়গিরি। উদয়গিরির অর্থ হল সূর্যোদয়ের পাহাড় । প্রবেশপথে রয়েছে সুসজ্জিত বাগান, চারিদিকে পাখীর গুঞ্জনে মুখরিত স্থানটিকে বেশ মনোরম লাগছিল। ASI এই অঞ্চলটির খননকার্যকে দুইটি সময়ে বিভক্ত করেছেন; ১৯৮৫- ১৯৮৯ পর্যন্ত সময় এবং এরপর ২০০৩ সাল পর্যন্ত সময় যখন দ্বিতীয়বার উৎখনন করে ৭ম থেকে ১২শ শতকের বেশ কিছু সম্পদ আবিষ্কার করা হয়েছিল।
এই মহাস্তুপের আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু হল এই মনেস্ট্রির চার প্রান্তে চারটি বৌদ্ধমূর্তি ধ্যানমগ্ন আছেন। এছাড়াও বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য এখানে একটি বিশাল বৌদ্ধমঠ আছে। এছাড়াও খননের পর এখানে কিছু বৌদ্ধ ভাস্কর্য যেমন তারা, মঞ্জুশ্রী মূর্তি ইত্যাদি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে ।
প্রাচীন হেরিটেজ সাইটগুলির মধ্যে এই স্থানটি অন্যতম; কারণস্বরূপ এখানে ২য় থেকে ১৩শ শতকের বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য বস্তু আবিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়াও এটি বেশ প্রাচীন বৌদ্ধ তান্ত্রিক কেন্দ্র। উদয়গিরিতে তন্ত্রসাধনার সূচনা প্রায় খ্রীস্টপূর্ব ৩০০ শতকে ।
উদয়গিরিতে মোট ৪ টি মনেস্ট্রি এবং ৩৬ মিটার অঞ্চল জুড়ে রয়েছে বৌদ্ধস্তূপের ধ্বংসাবশেষ। এখানে খনন করে আরও পাওয়া গিয়েছে টেরাকোটার বাসনপত্র, তামার মুদ্রা, রুপোর বেশকিছু জিনিসপত্র, বুদ্ধমূর্তি, বোধিসত্ত্ব এবং বুদ্ধ এর কিছু দৈবিক মূর্তি। রত্নগিরির কাছাকাছি ১৪কিমি অঞ্চলের মধ্যে আজও উৎখনন করলে তৎকালীন ইতিহাসের আরও বেশ কিছু তথ্য খুঁজে পাওয়া যাবে।
এই সব বৌদ্ধ স্থানগুলি ওড়িশার জাজপুর জেলায় অবস্থিত। পরিশেষে এই টুকু বলতে পারি ভারতের এই ঐতিহ্যগুলিই আমাদের সম্পদ।
এই হেরিটেজ-ডে তে আমরা সকলেই যদি একটু সচেতন হই তাহলে আমরা ভারতের রত্ন গুলিকে আগলে রাখতে পারি । তবে এই বিশাল কাজ সম্পন্ন করা কারওর একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ভারতের সকলে একসঙ্গে যদি ভারতের এই মূল্যবান সম্পদগুলি রক্ষার দায়িত্ব নিই, তাহলে ভারতের বাইরের পর্যটকরা ভারতের প্রাচীনত্ব এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবেন; আর আমরাও সেই ঐতিহ্যবাহী ভারতবর্ষের অধিবাসী হিসেবে গর্ব বোধ করব।
FOTW এর সোশ্যাল মিডিয়ার পেজ থেকে এই হেরিটেজ ভ্রমণ যাত্রা সম্পর্কিত তথ্য এবং সমস্ত ছবি পেয়ে যাবেন।