কলকাতা শহর হল সংস্কৃতির মিলনস্থল । এই শহরের খাদ্য তালিকায় দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে আক্রমণ এবং দেশান্তরিত হওয়ার ফলে অনেক নতুন খাদ্যের সংযোজন হয়েছে । যেমন জিভে জল আনা মুঘলাই খাদ্যগুলি অনুপ্রাণিত হয়েছে মহামেডান সম্প্রদায় থেকে আবার হাক্কা চাইনিজ খাদ্য গুলি চৈনিক সম্প্রদায় থেকে উদ্ভুত হয়েছে । এছাড়াও কলকাতা শহরে এমন অনেক ব্রিটিশ স্টাইলের বেকারি রয়েছে যার বয়স প্রায় প্রাক স্বাধীনতার সমসাময়িক। আর তাই খাদ্য রসিক মানুষের কাছে কলকাতা শহর স্বর্গীয় আমেজ এনে দেয় ।
কলকাতা শহরের খাদ্য তালিকাটি একটা ব্লগে শেষ করা সম্ভব নয় । তাই খাদ্য সম্ভারের তালিকাগুলি তিনটি খণ্ডে বিভক্ত করেছি ।
প্রথম খণ্ড - বাঙ্গালি -মুঘলাই - চাইনিজ খাদ্য
দ্বিতীয় খণ্ড - মিষ্টি এবং স্ট্রিট ফুড
তৃতীয় খণ্ড - কলকাতার নিজস্ব কিছু খাদ্য
বাঙালি খাদ্য -
১. ভজহরি মান্না :
কলকাতা শহরের প্রাচীন রেস্তোরাঁগুলির মধ্যে অন্যতম হল ভজহরি মান্না । এই রেস্তোরাঁটি বাঙালিদের ভোজন বিলাসে পরিতৃপ্তি এনে দেয়, তাও যথেষ্ট সুলভ মূল্যে । সুতরাং শহরের সব ধরণের মানুষই অনায়াসেই এই রেস্তোরাঁর খাবারের স্বাদ চেখে দেখতে পারেন । এই রেস্তোরাঁয় কখনও গেলে আপনি প্রাচীনত্বের ছোঁয়াকে উপলব্ধি করতে পারবেন ।
বিশেষত্ব - এখানে ডাব চিংড়ি, মটন ডাকবাংলো, ইলিশ পাতুরি চেখে দেখতে কিন্তু ভুলবেন না ।
২. আহেলী - দ্য পিয়ারলেস ইন :
বাঙ্গালীয়ানাকে উপলব্ধি করার জন্য পৌঁছে যেতে পারেন আহেলী - দ্য পিয়ারলেস ইন। শুধুমাত্র খাবার নয়, রেস্তোরাঁর অন্দরসজ্জা থেকে পরিবেশনায় রয়েছে বাঙ্গালী অভিনবত্ব । কলকাতা শহরের চৌরঙ্গী রোড এ অবস্থিত এই রেস্তোরাঁটি সমস্ত পর্যটকদের কাছে এক অন্যরকমের অভিজ্ঞতার স্বাদ এনে দেয় ।
বিশেষত্ব -এই রেস্তোরাঁর আকর্ষণীয় খাবারগুলি হল বাঙালি থালি, ভেটকি কারি, মটন কারি এবং চিংড়ি মালাই কারি ।
৩. কষে কষা -
এই রেস্তোরাঁটি অপেক্ষাকৃত নতুন সংযোজন হলেও বাঙালি খাদ্য ঐতিহ্যকে রক্ষা করে চলেছে দীর্ঘকাল ধরে ।
বিশেষত্ব- এই রেস্তোরাঁর পোলাও-এর সঙ্গে কষা মাংসের কম্বিনেশনটা জাস্ট অসাধারণ ।
৪. এলগিন রোডের কিউপিস -
বাড়ির খাবারের মতো স্বাদ পেতে চাইলে কিউপিস আদৰ্শ স্থান । কলকাতা শহরের এই রেস্তোরাঁটি খাঁটি বাঙালি খাদ্যের জন্য বেশ জনপ্রিয় ।
বিশেষত্ব- এখানে টেরাকোটার বাসনপত্রের সাহায্যে সমস্ত খাদ্য পরিবেশন করা হয় । তবে এই রেস্তোরাঁর আকর্ষণীয় খাবারগুলি হল মাংস ( মটন কারি ) এবং মালাই কারি চিংড়ি ।
৫. ৬, বালিগঞ্জ প্লেস -
দক্ষিণ কলকাতার এই বাঙালি রেস্তোরাঁটির মূল আকর্ষণ হল - এখানে মাছের কারি বেশ সুন্দরভাবে পরিবেশন করা হয় । এছাড়াও এখানে খাবারের স্বাদ চেখে দেখার জন্য আ-লা-কার্ট এবং ব্যুফে, দুইটি বিকল্পই উপলব্ধ আছে ।
বিশেষত্ব - এখানে যে কোনও মাছের পদ চেখে দেখতে একদম ভুলবেন না ।
চাইনিজ-
১. টেরিটি বাজার -
এখানে একজন চৈনিক বিক্রেতা হকারি করে বিক্রি করেন মোমো, ডিমসম, চাইনিস সসেজ, ফিশ বল নুডলস স্যুপ, ইত্যাদি। তবে এই সমস্ত খাদ্য চেখে দেখতে হলে সাত সকালে পৌঁছে যেতে হবে টেরিটি বাজার ।
২. ট্যাংরার চায়না টাউন -
এই রেস্তোরাঁর অধিকর্তা সিনো - ইন্ডিয়ান যুদ্ধের সময় ভারতে এসেছিলেন, এবং সঙ্গী হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন রকমারি হাক্কা চাইনিস খাদ্য।বিভিন্ন চাইনিজ মশলার সঙ্গে নির্মিত এই খাদ্য গুলি মিলিয়ে ভারতে 'ইন্ডিয়ান - চাইনিস' খাদ্য এর আখ্যায় ভূষিত হয়েছে । এখানে আপনি সুলভ মূল্যে সমস্ত চাইনিজ খাদ্যগুলির স্বাদ আস্বাদন করে নিতে পারেন ।
এই রেস্তোরাঁ অন্যান্য শাখাগুলি হল কিম লিং, বিগ বস, বেজিং, এবং গোল্ডেন জয় ।
এখানে হাক্কা নুডলস এর সাথে গোল্ডেন ফ্রাইড প্রন ট্রাই করে দেখতে পারেন । এছাড়াও সমস্ত রকমের আলকোহল এবং ব্রিজার কম খরচে পাওয়া যায় ।
মুঘলাই খাদ্য -
১৮৫৬ সালে ঔধ এর দশম নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ ব্রিটিশদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে লখনৌ পরিত্যাগ করে কলকাতায় আসেন । যেহেতু সেই সময় ব্রিটিশরা তাঁর রাজত্ব ধূলিসাৎ করে দেয়, তাই নবাব কলকাতার মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে লোখনৌ এর মতো ইসলামি ধারণাকে কেন্দ্র করে পারিখা, একটা চিড়িয়াখানা, ঘুরি ওড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট স্থান, কবুতরবাজি, এবং বিশাল রন্ধনকক্ষ নির্মাণ করেন । এছাড়াও এখানে খাবার খাওয়ার জায়গাও নির্দিষ্ট ছিল ।
খাদ্যের মধ্যেও তাঁরা রাজকীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করেন । কিন্তু অর্থের অভাবে নবাব-এর রন্ধনশিল্পীরা মাংসের বদলে আলু এবং ডিম দিয়ে নতুন বিরিয়ানির সৃষ্টি করলেন, যা বর্তমানে কলকাতা বিরিয়ানি নামে পরিচিত ।
১. আরসালান -
মুঘলাই খাবারের জন্য বেছে নিতে পারেন আরসেলান। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি পার্ক সার্কাস এর বিপণীটি হলো মূল আরসেলান।
বিশেষত্ব - এখানকার আকর্ষণীয় খাদ্য গুলি হল - মটন বিরিয়ানি, রেশমি কাবাব, ফিরনি ।
২. ওয়ুধ, ১৫৯০-
এই নব নির্মিত রেস্তোরাঁটির খাবার চেখে দেখতে একদম মিস করবেন না । এই ভিন্টেজ স্টাইল রেস্তোরাঁটির রয়্যাল আউধি খাদ্য এবং ক্যালড্রোন কুকড কারি বেশ জনপ্রিয় । খাবার পরিবেশনাতেও মুঘল সংস্কৃতি পরিলক্ষন করা যায় ।
বিশেষত্ব - এই রেস্তোরাঁর মূল আকর্ষণ রান বিরিয়ানি এবং গালৌতি কাবাব ।
৩. রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল -
এই রেস্তোরাঁটি কলকাতা শহরের সবচেয়ে প্রাচীন এবং এই ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁ যেটি বর্তমান প্রজন্মেও যথেষ্ট জনপ্রিয় । এই ভিন্টেজ হোটেলটির বর্তমানে অনেকগুলি শাখা রয়েছে, তবে চিৎপুরে অবস্থিত হোটেলটি সবচেয়ে প্রাচীন এবং প্রধান । একসময় উত্তমকুমার থেকে রাজ কাপুরও এই হোটেলে মুঘলাই খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ করতে আসতেন ।
বিশেষত্ব - এই হোটেলের বিশেষ খাবারগুলি হল মটন বিরিয়ানি এবং চিকেন চাপ ।
৪. সিরাজ -
কলকাতা শহরের বিরিয়ানি রসনার জন্য সিরাজ অন্যতম প্রাচীন রেস্তোরাঁ । এদের অন্যান্য শাখাগুলিও বেশ জনপ্রিয় ।
প্রসঙ্গত, আমিনিয়া, জীশান, নৌশিজান, আলিবাবা, হাজি সাহেব রেস্টুরেন্ট এবং হ্যাংলাথেরিয়াম ও কলকাতা শহরের নামজাদা বিরিয়ানি কালেকশন এর জন্য বিখ্যাত ।
৫. নিজাম -
বিরিয়ানি প্রেমী মানুষের অন্যতম পছন্দের জায়গা হলো নিজাম । যদিও নিজাম বাংলার কাঠি রোল এর জন্য বিখ্যাত, তবুও নিজামের বিরিয়ানিকে উপেক্ষা করা যায় না । এই রেস্তোরাঁয় বিরিয়ানির সঙ্গে কাবাব এর কম্বিনেশনটা চেখে দেখতে পারেন ।
বিরিয়ানি প্রসঙ্গে বলি, নিজাম প্রধানত বিফ বিরিয়ানির জন্য বিখ্যাত । এখানে মাত্র ৫৫০ টাকায় দুজন খেতে পারেন ।
৬. মিত্র ক্যাফে -
বিখ্যাত মুঘলাই পরোটা খেতে পৌঁছে যান মিত্র ক্যাফে। এই রেস্তোরাঁটি যেমন প্রাচীন, তেমনি ফাস্ট ফুড প্রেমী দের কাছে স্বর্গ বললে কিছু ভুল হবে না ।
বিশেষত্ব - মিত্র ক্যাফের মূল আকর্ষণ হল - ফিশ কাটলেট, ফাউল কাটলেট, এবং মুঘলাই পরোটা ।
খাদ্য ব্যঞ্জনের মধ্যে কোন পদটা আপনার বিশেষ পছন্দের লিখে জানাতে কিন্তু ভুলবেন না ।