ভারতবর্ষের মানুষদের সঙ্গে কিন্তু মা গঙ্গার সম্পর্ক নিবিড়। নদীমাতৃক সভ্যতার আধারে বেড়ে ওঠার সময় তিনিই ছিলেন আমাদের ধারক এবং বাহক। সন্তানের মতো তিনি আমাদের মানুষ করছেন, আমাদের বাসভূমিকে শস্য শ্যামলা করে তুলেছেন, পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনায় হয়েছেন আমাদের তর্পণ প্রার্থনার ভূমি। তাই গঙ্গার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রাচীন, অনেকাংশে আধ্যাত্মিক। যুগ যুগ ধরে বহু কাহিনি, বহু পুরাণে দেখা পাওয়া গেছে এই মহানদীর, গড়ে উঠেছে নানান গল্প। দেখে নিই, সেই গঙ্গার মহিমা আমরা কতটা জানি।
পুরাণে গঙ্গা - গঙ্গার মর্ত্যে আগমন
পৌরাণিক মতে আমাদের ভুবনে গঙ্গার আগমন হয়েছিল বামনদেবের কারণে। মর্ত্য হতে স্বর্গে গমন করার সময় বামনদেবের পায়ের নখের আঘাতে জাগতিক মহাবিশ্বের এক কোণায় একটি ছিদ্রের সৃষ্টি হয়। এই ছিদ্র দিয়েই আমাদের মহাবিশ্বে গঙ্গা নদীর প্রথম আবির্ভাব ঘটে।
বেশ কিছুকাল পরে ইক্ষাকু রাজবংশে আবির্ভাব হয় রাজা ভগীরথের। ভগীরথ জানতে পারেন যে তাঁর নিষ্টুর পূর্বপুরুষদের আত্মা কপিলা মুনির অভিশাপে এখনও মর্ত্য লোকে বিচরণ করছে। তাঁদের আত্মার মুক্তিকামনায় তিনি তাঁর সাম্রাজ্য ত্যাগ করে গুরু ত্রিথলার পরামর্শে গঙ্গার কাছে প্রার্থনায় ব্রতী হন।
হাজার বছর প্রার্থনার পরে ইন্দ্রের দর্শন পেলে ভগীরথ বলেন যে একমাত্র গঙ্গা নদীর জল-ই পারবে সমস্ত জাগতিক পাপের স্খলন করতে এবং তাঁর পূর্বপুরুষদের মুক্তি দিতে। তাই ইন্দ্রের বরে গঙ্গা পৃথিবীতে আসেন, কিন্তু বিনা প্ররোচনায় পৃথিবীতে আগমনে বাধ্য করানোয় গঙ্গা কুপিত এবং প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠেন। এমন বেগে এবং বিক্রমে গঙ্গা পৃথিবীতে বইতে শুরু করেন, যে মহাপ্রলয় আসন্ন হয়ে ওঠে।
ভাগীরথ তখন যান ভগবান শিবের কাছে। ভাগীরথের নিঃস্বার্থ প্রার্থনায় প্রীত হয়ে শিব আবির্ভূত হন এবং জগৎসংসারকে প্রলয়িনী গঙ্গার হাত থেকে রক্ষা করতে উদ্যত হন। ভগবান শিব অতঃপর মা গঙ্গাকে তাঁর কেশজটায় ধারণ করেন। কেশজটা হতে ধীরে ধীরে নিঃসৃত হয়ে গঙ্গা আমাদের পরিচিত নদী রূপ ধারণ করেন। এই কারণেই উৎপত্তি স্থল হতে দেবপ্রয়াগ পর্যন্ত গঙ্গা নদী ভগীরথী নামেই পরিচিত।
মহাভারতে গঙ্গা - শান্তনু এবং গঙ্গা
গঙ্গার সঙ্গে সংযুক্ত আরেকটি কাহিনী আমরা জানতে পারি মহাভারতের পাতা থেকে। মর্ত্যে বিচরণের পর তাঁকে স্ত্রী রূপে দেখতে পান রাজা শান্তনু। গঙ্গার রূপে মোহিত হয়ে শান্তনু গঙ্গাকে বিবাহপ্রস্তাব দেন। কিন্তু গঙ্গা কোনওপ্রকার বন্ধনে আবদ্ধ হননা। তিনি বলেন তিনি শান্তনুর রানি হিসেবে থাকতে প্রস্তুত, কিন্তু তাঁকে কোনও বিষয়ে কোনও রকম প্রশ্ন করা যাবে না।
পরবর্তী সময়ে শান্তনুর রানী থাকাকালীন অবস্থায় মানবীরূপী গঙ্গা সাত সন্তানের জন্ম দেন এবং ব্যক্তিগত কারণে তাদেরকে নদীরূপী গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেন। সন্তানশোকে বিহ্বল হয়ে ওঠেন শান্তনু। অষ্টমবার গঙ্গা যখন অষ্টম সন্তানটিকে বিসর্জন দিতে উদ্যত হন, সহ্য করতে না পেরে শান্তনু গঙ্গার থেকে এই আচরণের উত্তর চান। গঙ্গা অষ্টম পুত্রটিকে শান্তনুর হেফাজতে রেখে আবার নদীরূপে বিলীন হয়ে যান। পরবর্তী কালে এই অষ্টম শিশুটি বড় হয়ে উঠে আমাদের কাছে পরিচিত হন প্রপিতামহ ভীষ্ম রূপে।
বর্তমানে গঙ্গা - গঙ্গা নদীর প্রতি আমাদের দায়িত্ব
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমানে গঙ্গা নদী পৃথিবীর সবথেকে দূষিত নদীর তালিকায় ষষ্ঠ স্থান ধারণ করছে। আমরা যারা ভারতবাসী, যারা পর্যটক হিসাবে মা গঙ্গার মহিমা চাক্ষুস দেখতে বারবার বারাণসী, প্রয়াগ, গঙ্গোত্রী তে ছুটে গেছি; মনুষ্যজাতির প্রতিনিধি হিসেব আমাদের উচিৎ গঙ্গানদীকে সঠিক মর্যাদা দেওয়ার। আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দায়িত্ব গঙ্গাদূষণ যথাসাধ্য কমিয়ে আনা এবং গঙ্গাকে স্বমহিমায় বইতে দেওয়ার।