নারী শব্দের আভিধানিক অর্থ যতটা না গভীর বরং তার চাইতেও বড় তার দায়িত্ব। কথায় বলে, ভগবানের এক অমূল্য সৃষ্টি হল নারী। প্রতিটি মানুষের জীবনের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রূপে এক বা একাধিক নারীর আগমন ঘটে থাকে। আর সেই সমস্ত ‘সর্বংসহা’ নারীদেরকে সম্মান জানাতে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সূচনা।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস:-
আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রধানত নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায় সংগ্রামের ইতিহাস। পূর্বে যার নাম ছিল ‘আন্তর্জাতিক শ্রম নারী দিবস’। নারীদের প্রতি ভালোবাসা, তাদের কাজের অধিকার, মজুরির বৈষম্য, কাজের চাপ, কাজের সময় নির্ধারণ, মানসিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ১৮৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায় প্রতিবাদ করেন সুতো কলকারখানার নারী শ্রমিকরা। এরপর আস্তে আস্তে এই প্রতিবাদ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯০৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান নেত্রী ক্লারা জেটকিন-এর নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন পালিত হয়।
এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় সম্মেলনটি, যেখানে ১৭টি দেশ থেকে মোট ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগদান করেন এবং এই সম্মেলনের ক্লারা প্রতিবছর ৮ই মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে পালন করার প্রস্তাব দেন। পরবর্তীতে ১৯১১ সাল থেকে নারীদের সমঅধিকারের জন্য এই দিনটি পালন করা শুরু হয়। এরপর ১৯১৪ সালে বেশ কয়েকটি দেশ ৮ই মার্চ নারী দিবস পালন করতে শুরু করে। ফলে, ১৯৭৫ সালে ৮ই মার্চ দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এরপর থেকে পৃথিবীর এক এক প্রান্তে এক এক উদ্দেশ্য নিয়ে এই নারী দিবস পালিত হয়। মূলত, নারীদের সাধারণ সম্মান, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের আর্থিক রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উপর গুরুত্ব দেওয়ার কারণেই এই আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়ে আসছে। আফগানিস্থান, আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কম্বোডিয়া, কিউবা, জর্জিয়া, কাজাকিস্তান, কিরগিস্থান, মঙ্গোলিয়া এবং রাশিয়া প্রভৃতি দেশগুলিতে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজও এই দিনটিতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও চীন, মাদাগাস্কার, নেপালে এই দিনটি শুধুমাত্র নারীদের জন্য সরকারি ছুটির প্রদান করা হয়।
নারীদের কথা:-
নারীরা আজ যে কেবল সংসারের চার দেওয়ালের মধ্যেই আবদ্ধ তা নয়, তারা বাইরের জগতের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছে। বলা ভাল, নিজের পরিচিতি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তাই আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমরা সেই সমস্ত নারীদের সম্মান জানাব, যারা প্রতিনিয়ত নিজের জীবন-যুদ্ধের সঙ্গে সংগ্রাম চালিয়ে পারিপার্শ্বিক বাধা-বিপত্তির চক্রব্যূহ ভেদ করে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে সাফল্যের চূড়ায়।
হিমা দাস
আসামের একটি ছোট্ট গ্রামের কৃষক পিতার ঘরে জন্ম নেওয়া কন্যা সন্তান হিমা দাস ভারতীয় সোনা বিজেতা অ্যাথলেটিক হিসেবেই পরিচিত। যাঁর পা মাটির স্পর্শ করলেই ভারতের গর্ভগৃহ সজ্জিত হয় স্বর্ণ অথবা রৌপ্য পদকে। এইটুকুই শেষ নয়, ২০২১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি হিমা দাস আসাম পুলিশের ডিএসপি পদে যোগদান করেছেন, যা প্রতিটি মানুষের কাছে অত্যন্ত গর্বের।
কেয়া শেঠ-
অল্প বয়সী এই বিবাহিত রমণী দুটি সন্তানকে নিয়ে মাত্র ১২০ বর্গফুট জমির উপর তৈরি করা ‘প্রিয়দর্শিনী’ পার্লার থেকে তাঁর জীবন যুদ্ধ শুরু করেন। নিজের দূরদর্শিতা, আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য এবং সততার বলে আজ তিনি শুধু রাজ্যই নয় সারা পৃথিবীর কাছে অ্যারোমা থেরাপিস্ট হিসাবে পরিচিত মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আজ দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাঁর তৈরি করা বিউটি পার্লারে বহু মানুষ নিজেদেরকে সুন্দর করে তোলবার আশায় প্রতিনিয়ত যাতায়াত করেন। শুধু তাই নয়, এই কাজের প্রতি অসম্ভব ভালোবাসার জন্য তিনি তিনটি জাতীয় এবং চারটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন।
স্বাতী সর্ফ
রসগোল্লার জন্ম বাংলা না ওড়িশা এই দ্বন্দ্বের মাঝখানে রসগোল্লাকে আরও রসালো করার কাজে যিনি নিযুক্ত হন আজ তাঁর কথাই বলা হবে। কৃত্রিমতাকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন সবজি ও ফলের নির্যাস থেকে ২৭০টিরও বেশি স্বাদের রসগোল্লা তৈরি করে স্বাতী সর্ফ আজ শুধু রাজ্যের নয় দেশের বাইরেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন।
রিচা আগরওয়াল-
শিল্পের প্রতি ভালোবাসা এবং সৃষ্টিশীল মনোভাব নিয়ে ইএমবাইপাসের কাছে প্রায় ৭০হাজার বর্গফুট জমির উপর গড়ে ওঠা কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিটিভিটি অন্যতম উদ্যোক্তা ইমামি আর্ট-এর কর্ণধার শ্রী আর.এস আগরওয়াল-এর সুযোগ্য পুত্র বধূ রিচা আগারওয়াল। যার মস্তিষ্কপ্রসূত ক্রিয়েটিভিটির কারণে একই ছাদের তলায় রয়েছে বিভিন্ন ভাস্কর্য, পেন্টিং, সেরামিকের কাজ, ফটোগ্রাফির মতো শৈল্পিক কাজগুলি। তার সঙ্গে নাচ, গান এবং খাবারের মত বিষয়গুলিও। শিল্পপ্রেমীরা এখানে এসে বিভিন্ন শিল্পের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন এবং সেইসঙ্গে বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কাছ থেকে কাজও শিখে নেওয়ার মতন সুবিধা রয়েছে এখানে।
ড. স্বাতী মোহন
ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই মার্কিন বিজ্ঞানী কিছুদিন আগে তাঁর মঙ্গল অভিযানের সফলতা নিয়ে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছেন। কর্নেল ইউনিভার্সিটির স্নাতক এই বিজ্ঞানী রোভার ল্যান্ডিং অভিযান অপশনের মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন। পারসিভিয়ারেন্স রোভার মঙ্গলের মাটির স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে খুব দ্রুততার সঙ্গে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং তার থেকেও বেশি ভাইরাল হয় এই মানুষটির কপালের ছোট্ট টিপটি। যে প্রসঙ্গে অনেক ভারতীয় বলেছেন, ডক্টর স্বাতী মোহন তাঁর ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি অত্যন্ত যত্নবান। তাই তিনি কপালে টিপ পড়েন।
চুমকি শর্মা
বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বিয়ে, তারপর সন্তান এবং পরবর্তীতে বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ার পরে সিঙ্গেল মাদার থেকে ২০১৮ সালের মিসেস ইন্ডিয়া কুইন অফ সাবস্ট্যান্সের বিজয়ী।
এবার যাদের কথা বলা হবে, তাদের কথা না বললে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করাটাই বৃথা। তারা হলেন আমাদের সকলের ‘মা’। আমাদের জীবনের প্রথম নারী, যিনি প্রতিনিয়ত নিজের স্বপ্নগুলোকে একটা সীমিত গণ্ডির মধ্যে রেখে একজন সন্তানকে বুকে আঁকড়ে ধরে তাকে সাফল্যের সিঁড়িতে পৌঁছে দেন।
সামাজিক নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে যিনি শুধুমাত্র তার পরিবারের জন্য ক্রমাগত লড়াই করে চলে আর দিনের শেষে যার মুখে সর্বদা হাসি মিষ্টি ছোঁয়া দেখতে পাওয়া যায়। তারা হয়তো সরকারিভাবে ঘোষিত আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ছুটি উপভোগ করতে পারেন না, তবুও তারা আমাদের মধ্যে সেই সাহসিকতা এবং সততার মেরুদণ্ড স্থাপন করে বলতে শেখান ‘আমরা নারী আর আমরাই পারি’।