সমস্ত নারীর বিশেষত্ব হল যত্নশীলতা এবং সহনশীলতা। আবার অনেকসময় নিজের ইচ্ছেগুলোকে দমিয়ে রেখে অপরের চাহিদা পরিপূর্ণ করাও নারীদের গুণের মধ্যে একটি অঙ্গ । নতুন শহরকে জানার বা নতুন দেশকে চেনার অভিপ্রায় কম বেশি সব মানুষের মনেই গোপন থাকে। কিন্তু একজন নারীর পক্ষে একাকী ভ্রমণ করার তেমন একটা সুযোগ হয় না। এর প্রথম কারণ হল নিজের পরিবার, অফিসের কাজের চাপ বা অনেকসময় প্রিয় পোষ্যটিকে একা রেখে বেরোনো সম্ভব হয় না । দ্বিতীয়ত, আপনি যদি বন্ধুদের সঙ্গেও ভ্রমণের প্ল্যান করেন তাহলেও শেষমুহুর্তে সেই প্ল্যানটা ভেস্তে যায় এবং পরিবারের পক্ষ থেকেও একা ভ্রমণের অনুমতি পাওয়া যায় না।
আর তাই নারী দিবসের প্রাক্কালে সমস্ত পাঠকদের জন্য নিয়ে এসেছি ৫জন মহিলা পর্যটকের অনুপ্রেরণামূলক ভ্রমণ কাহিনি । আশা রাখি, এই ব্লগটা সম্পূর্ণ পড়ে ফেলার পর ভ্রমণ সম্পর্কে মানুষের মানসিকতার বেশ কিছুটা পরিবর্তন ঘটবে । নারীরাও কিছুটা স্বাধীনচেতা হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে টিকিট কেটে বাঁধনহারা পাখির মতো দেশান্তরিত হতে বেড়িয়ে পড়বেন ।
১. আমেরিকান পর্যটক ক্যাসি দে পেকল, যিনি সবচেয়ে কম সময়ে পৃথিবীর সমস্ত মহাদেশ ভ্রমণ করেছেন । নথি অনুযায়ী ইনি হলেন আমেরিকার সবচেয়ে কনিষ্ঠ মহিলা যিনি সবচেয়ে দ্রুত এই ট্রিপ সম্পন্ন করেন ।
পেকল পৃথিবীর ১৯৬ টি দেশ ভ্রমণ মাত্র ১৮মাস এবং ২৬ দিনে সম্পন্ন করেন । মাত্র ২১বছর বয়সে ২,০০০ ডলার খরচ করে বেড়িয়ে পড়েন ইউরোপের উদ্দেশ্যে । প্রায় দুই বছরের ভ্রমণের ইচ্ছাকে সম্পূর্ণ করার জন্য বিভিন্ন হোটেলে কর্মরত থেকে আয় করেন এবং সেই আয় থেকেই সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণ করেন । ভ্রমণকালীন সময়ে মহিলা হয়ে নিজেকে রক্ষার জন্য তিনি ইসরায়েলি মার্সেল আর্ট ক্রাভ মাগাও শিখে নেন।
২. অ্যানি লন্ডন্ডেরি বা অ্যানি কোহেন কপাচোভস্কি, যিনি ১৮৯৪ সালে ১৫মাস যাবৎ শুধুমাত্র সাইকেলের সাহায্যে বিশ্ব পরিদর্শন করেছিলেন । সেই সময় কোনও একাকী নারীর বিশ্ব ভ্রমণ সমাজের কাছে নারীবাদী চেতনাকে জাগিয়ে তোলে, তা বলাই বাহুল্য।
বিশ্বের দরবারে অ্যানি প্রথম মহিলা যিনি সাইকেল নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ করেছেন । ভ্রমণের টানে তিনি তাঁর পরিবার, স্বামী এমনকি সন্তানকে ছেড়েও দেশান্তরিত হয়েছিলেন । কী ভাবছেন, দায়িত্বজ্ঞানহীন? হয়তো তাই । কিন্তু অ্যানি এই মানসিকতা সমস্ত ভ্রমণপ্রিয় নারীদের কাছে একটা দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ।
৩. পর্বতারোহী জুনকো তা-বেই প্রথম মহিলা যিনি মাউন্ট এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করেন । শুধু তাই নয়, তাবেই পৃথিবীর ৭টি মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আরোহন করার জন্যও প্রথম মহিলা পর্বতারোহী হিসেবে পরিচিত । সাতটি গ্রন্থের লেখিকা তাবেই তাঁর ৭০তম জন্মদিনে মোট ৫৬ টি দেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গগুলো জয় করে ফেলেন।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে স্বাধীনচেতা নারীবাদের পরিচয় দিয়েছেন তিনি । তাবেই এর বক্তব্য ছিল -"নারীরা কর্মরতা হলেও, চা পরিবেশনের জন্য নারীকেই বলা হয় " । তিনি জাপানে ১৯৬৯ সালে নারীদের পর্বত আরোহনের জন্য একটি ক্লাব চালু করেন যার নাম ছিল 'লেডিস ক্লাইমবিং ক্লাব ' ।
৪. লরা ডেকর কনিষ্ঠতম ( লিঙ্গ ব্যাতিরেকে ) নাবিক হিসেবে পরিচিত ।মাত্র ১৪বছর বয়সে একাকী বিশ্ব ভ্রমণের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন তিনি । ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে যাত্রা শুরু করেন এবং ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি নিউজিল্যান্ড পৌঁছান । প্রায় দেড় বছরের এই যাত্রা পথের দূরত্ব ছিল ৩৬,০০০ নটিক্যাল মাইল । একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের ক্ষেত্রে জলপথে বিশ্ব ভ্রমণের স্বপ্নটাকে বাস্তবে পরিণত করার কাজটা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না ।
ডাচ সরকার কর্তৃপক্ষ ভেবেছিলেন একা কুমারী মেয়ের জন্য এই ভ্রমণ খুবই বিপজ্জনক হবে, তাই হাজতবাস করানোর হুমকি দিয়ে জলপথে বিশ্ব ভ্রমণের ইচ্ছাটাকে দমন করার চেষ্টা করেছিলেন । এরপর কোর্ট-এ তাঁর এই সঙ্কটপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে বহু মতভেদ হয় এবং তাঁর বাবা মা এর প্রতি আনুগত্য এবং নৌচালনার অভিজ্ঞতা ও প্রদর্শন করতে বলা হয় । এই স্বপ্নভঙ্গ করার চেষ্টার জন্য ডাচ সরকার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে লরার মনে একটা ক্ষোভ সৃষ্টি হয় এবং যাত্রাপথে তিনি তাঁর বোটের পতাকা পরিবর্তন করে নিউজিল্যান্ডের পতাকা উত্তোলন করেন। পরবর্তীকালে তিনি নিউজিল্যান্ডের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে লরা তাঁর স্বামী ড্যানিয়েল কে নিয়ে সেই বোটেই বসবাস করেন ।
৫. জেন্নি বারেট হলেন প্রথম জলপথে বিশ্ব ভ্রমণকারী মহিলা। ১৭৬৬ থেকে ১৭৬৯ সালে তিনি বিশ্ব ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে ছিলেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কারণে তিনি পুরুষদের আভরণ গ্রহণ করেছিলেন। প্রায় ২বছর তিনি ফরাসি নাবিকদের জাহাজে যাত্রা করেছিলেন । শরীরের উপরের অংশ সমান রাখার জন্য তিনি সবসময় লিনেন ব্যাণ্ডেজের কাপড় দিয়ে যতটা সম্ভব শক্তভাবে শরীরের উপর জড়িয়ে রাখতেন । ফরাসিদের সেই ছোট্ট জাহাজে প্রায় ৩০০ মানুষ থাকতেন এবং সকলেই জেন্নি কে জেন হিসেবেই চিনত।
তৎকালীন সমাজে এই উদ্ভিদবিদ এবং ভ্রমণ পিপাসু নারীর উদাহরণটা আজকের দিনেও সমানভাবে নারীবাদী চেতনাকে জাগিয়ে তোলে ।
পুরুষ পাঠকদের উদ্দেশ্যে জানিয়ে রাখি, আপনার মা, বোন, বন্ধু বা স্ত্রীকে উপহার হিসেবে একটা ভ্রমণ ট্রিপ প্ল্যান করে দিতে পারেন ।
বস্তুগত কোনও উপহার কিন্তু মনকে বেশিক্ষণ সতেজ রাখতে পারে না । একমাত্র ভ্রমণই অনাবিল আনন্দের সৃষ্টি করতে পারে ।
এই নারীদিবসে স্বাধীনচেতা মনে মুক্ত বিহঙ্গের মতো দেশান্তরিত হচ্ছেন তো? আমরা আপনার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম ।
আমরা নারী, আমরা সবকিছুই পারি ।👍