আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন এক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যার সঙ্গে বর্তমানে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আপনি কল্পনা করুন, আপনি কমপ্লেক্স-এর মধ্য দিয়ে কাঁধে ঝোলা ব্যাগ আর হাতে বই নিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকছেন, আপনার চারপাশে রয়েছেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছাত্র এবং শিক্ষক । আর আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের চারিদিকে রয়েছে অনেকগুলি মনেস্ট্রি। আপনি কি লাদাখ বা স্পিতি ভ্যালির কথা ভাবছেন? প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি হিমালয়ান মনেস্ট্রিগুলির থেকেও প্রাচীন। এটি প্রাচীন কালে যথেষ্ট প্রভাবশালী থাকলেও বর্তমানে এটি একটি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে । হ্যাঁ আপনার অনুমান এক্কেবারে সঠিক, চলুন আজ আরও একবার অতীতের সেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে আসি।
একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি পঠনপাঠনের মূল পীঠস্থান হিসেবে পরিগণিত হত। যে স্থানে প্রথম বৌদ্ধ ধর্মের আত্মপ্রকাশ, সেই স্থানেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপত্তি। বৌদ্ধদের এই প্রথম শিক্ষাক্ষেত্রটির উন্মেষ ঘটে আজ থেকে বহু বছর পূর্বে। তবে শত্রুপক্ষের হামলায় অতীতের গৌরব একসময় ধ্বংসপ্রায় হয়ে যায়।
সংস্কৃতে 'নালন্দা' শব্দটিকে না + আলম +দা এই তিনটি অক্ষরে বিভক্ত করলে এর সম্পূর্ণ আক্ষরিক অর্থ হল - 'জ্ঞান কে উপহার হিসেবে প্রদান করলে তা কখনওই কম হয়ে যায় না'। আধুনিক যুগের মতোই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পঠন ব্যবস্থা, লাইব্রেরি, হোস্টেল ব্যবস্থা, এই সমস্ত কিছুর যথেষ্ট সুযোগ ছিল। একটি কমপ্লেক্স-এ প্রায় ২০,০০০ ছাত্র অধ্যয়ন করতে পারতো এবং বিদ্যাচর্চার এই প্রক্রিয়া এবং পরিচালনার জন্য ২০০০ শিক্ষক নিযুক্ত ছিলেন।
নালন্দা শহরটি বিহার ঝাড়খণ্ড বর্ডারে অবস্থিত। নালন্দা পৌঁছতে হলে প্রথমে ট্রেন ধরে পৌঁছে যান পাটনা কিংবা গয়া। স্টেশন থেকে বিহার শরীফ গামী বাস ধরে পৌঁছে যেতে পারেন নালন্দা। এই স্থানটি হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন তীর্থযাত্রীদের কাছে বেশ প্রসিদ্ধ। শীতকালীন সময় বিশেষত নতুন বছরে দেশি বিদেশি বহু পর্যটকের সমাগম ঘটে এই নালন্দায়। বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তিস্থল বিহার হয়ে কীভাবে সমগ্র এশিয়া এবং তার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে সেটা জেনেও বেশ রোমাঞ্চকর লাগে।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজি কমপ্লেক্স বর্তমানে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট-এর আখ্যায় ভূষিত। এই ধ্বংসাবশেষ পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বেশ অনেকটা স্থান জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছিল।
কীভাবে নালন্দা পৌঁছবেন -
নালন্দার নিকটতম রেলস্টেশন হলো গয়া । এই গয়াতেই ভগবান বুদ্ধদেব এর প্রথম বোধি প্রাপ্তি হয় ।বুদ্ধগয়া পৌঁছে মহাবোধি মন্দির দর্শন করে বাস বা ট্যাক্সি সহযোগে দুই ঘণ্টার দূরত্বে পৌঁছে যান নালন্দা। পায়ে হেঁটে সমস্ত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করতে সময় লাগবে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার মতো।
পারিপার্শ্বিক দর্শনীয় স্থান -
যেহেতু নালন্দা বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের প্রধান তীর্থস্থান তাই অনেকসময়ই বৌদ্ধদের তীর্থযাত্রা নেপাল থেকে শুরু করে সারনাথ-এ সম্পন্ন হয় । ইচ্ছা করলে আপনি ভ্রমণ প্ল্যানটা এইভাবে তৈরি করে নিতে পারেন - বুদ্ধ গয়া - রাজগীর - নালন্দা - সারনাথ -গোরক্ষপুর - কুশিনগর -লুম্বিনী - সারস্বত - লখনৌ - নিউ দিল্লি।
নালন্দার নিকটবর্তী সিলাও গ্রামটি জনপ্রিয় মিষ্টান্ন খাজার জন্য প্রসিদ্ধ। এখানে এমন কয়েকজন বিক্রেতা এবং বিপণী রয়েছে যাদের পূর্বপুরুষরাও খাজার নির্মাণের জন্য বিখ্যাত ছিলেন ।
নালন্দা থেকে কিছু দূর এগিয়ে দর্শন করে আসতে পারেন হিউ-এন-সাং মেমোরিয়াল হল। এখানে আপনি প্রাচীন বিদেশি পর্যটকের জীবনকাহিনি এবং তাঁর দুর্গম যাত্রা সম্পর্কে অনেক তথ্য জেনে নিতে পারেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে কিছু কিমি দূরে ব্ল্যাক বুদ্ধ স্ট্যাচু দর্শন করে নিন। কালো পাথরে নির্মিত বৌদ্ধদেবের মূর্তি এখানে ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় স্থাপিত আছেন। খননকার্যের সময় এই মূর্তিটি উদ্ধার করা হয় এবং বর্তমানে এই মূর্তিকে কেন্দ্র করে মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। এরপর জৈন ধর্মের মূল পীঠস্থান এবং মহাবীর এর জন্মস্থান কুন্ডালপুরের জৈন মন্দির পরিদর্শন করে নিন।
একাকী পর্যটকদের জন্য নালন্দা ভ্রমণ কিছুটা হলেও অসম্ভব। এখানে বেশিরভাগ বাস সময় অনুযায়ী চলে না তাই পাবলিক বাস খুঁজে পাওয়া প্রায় দুস্কর। তবে প্যাকেজ ট্যুর করতে চাইলে বেনারস থেকে পাঁচ দিনের ট্রিপ ট্রাই করে দেখতে পারেন । আপনি যদি শুধু মাত্র বৌদ্ধ স্থানগুলি পরিদর্শন করতে চান তাহলে অন্য পর্যটকদের সঙ্গে একটা টিম বানিয়ে ভ্রমণ করতে পারেন।
সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সময়টি নালন্দা ভ্রমণের জন্য শ্রেষ্ঠ সময় ।