ভারতের যে কোনও মানুষকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে বাংলা নামটি বললে সর্বপ্রথম কোন জিনিসগুলি তাঁদের মাথায় আসে, সেক্ষেত্রে উত্তরটা নিশ্চয়ই হবে রসগোল্লা এবং বাংলার তাঁত শাড়ি। কিন্তু বাংলা রাজ্যটি শুধুমাত্র রসগোল্লা এবং তাঁত শাড়ির বশবর্তী নয়। বাংলার ঐতিহ্য এবং শিল্পের সঙ্গে একাত্ব হয়ে আছে ‘হিঙ্গুল পুতুল' বা 'বালুচরী'-ও। চলুন না, আজ এই ব্লগ-এর মাধ্যমে ‘লাল মাটির দেশ’ বাঁকুড়া থেকে ঘুরে আসা যাক।
মেচা মহলের মেচা সন্দেশ -
যাত্রার শুরু হোক মিষ্টি মুখ দিয়ে। বাঁকুড়া জেলাটি এই মেচা সন্দেশের জন্য কিন্তু বেশ জনপ্রিয়। আপনি নিশ্চয় ভাবছেন মিষ্টির এই ধরনের অদ্ভুত নামকরণ কেন? তাহলে চলুন এই মিষ্টির ইতিহাসটা একটু জেনে নেওয়া যাক। ১৬২৫- ১৬৩৫ সালে বাঁকুড়ায় মল্লরাজার রাজত্ব কালে শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে দুধের ঘাটতি ঘটে। কিন্তু সন্দেশ তো দুধ ছাড়া বানানো সম্ভব নয়! অন্যদিকে রাজা এবং তাঁদের প্রজাগণের মিষ্টির জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত। শেষে বেসন এবং খোয়াক্ষীর সহযোগে শুরু হল এক নতুন মিষ্টির আবির্ভাব।
সেই সময় ছোলা থেকে বেসন তৈরি করা হত, তারপর ঘি-এর মধ্যে বেসনটা ভেজে নিয়ে চিনির সিরাপ এবং খোয়াক্ষীর সহযোগে রান্না করা হত। খোয়াক্ষীর বাংলার অন্যান্য জেলাগুলি থেকে আমদানি করা হত। এই মিশ্রণটি ধীরে ধীরে নরম হয়ে এলে ঠান্ডা হওয়ার আগে ছোট ছোট বল আকারে বানিয়ে আরও একবার চিনির সিরাপে ডুবিয়ে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে মেচা সন্দেশ। বাঁকুড়ার সমস্ত জায়গায় এই মিষ্টি পেয়ে যাবেন, তবে বেলিয়াটোরের ‘মেচা মহল’-এর মেচা সন্দেশ সবচেয়ে প্রসিদ্ধ।
দশাবতার তাস সেন্টারের (বাসরী ফৌজদার) দশাবতার তাস -
বাঙালি হিসেবে তাস খেলতে নিশ্চয় ভালোবাসেন। তবে এই খেলাটা ৫২ কার্ডের খেলা থেকে একটু আলাদা। এই দশাবতার তাসখেলাটি প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন এবং এখানে কার্ডের মোট সংখ্যা হল ১২০টি। এই খেলার প্রচলন ঘটান মল্লরাজা, আর প্রত্যেকটি কার্ডে ভগবান বিষ্ণুর দশঅবতারের চিত্র সুনিপুণ ভাবে অঙ্কিত রয়েছে। কাপড়, তেঁতুলের আঠা, চুন, রং ইত্যাদি সামগ্রী সহযোগে কার্ডগুলি তৈরি করা হয়। এই খেলায় মজার ব্যাপারটা হল, প্রত্যেক দিনের এবং প্রত্যেক বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় অনুসারে খেলার নিয়মগুলি পরিবর্তিত হয়। আধুনিক যুগে প্রযুক্তির বিকাশের কারণে এই প্রাচীন খেলাটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে কিছু ফৌজদার পরিবার আজও বংশানুক্রমিকভাবে এই তাসের শিল্পটিকে টিকিয়ে রেখেছে। বিষ্ণুপুরের শাঁখারি বাজার এলাকায় এই ফৌজদার পরিবারগুলির অবস্থান।
এই ধরণের কার্ড বানানোর পদ্ধতি পরিশ্রমসাপেক্ষ এবং সময় সাপেক্ষ; সেই কারণেই কার্ডগুলি বেশ দামি। ১০ টি কার্ডের প্যাকেটের দাম ৪০০০ টাকা, ১২০ কার্ডের সম্পূর্ণ সেট এর দাম ৭০০০ টাকা। এছাড়াও ফৌজদার পরিবারগুলি বর্তমানে লণ্ঠণের মধ্যেও দশাবতার অঙ্কন করছেন, এই লণ্ঠণ গুলির দাম প্রায় ৭০০-৮০০ টাকা ।
হিঙ্গুল পুতুল -
হিঙ্গুল পুতুল হল প্রাচীন একটি শিল্পের নিদর্শন। একমাত্র ফৌজদার পরিবারের মহিলারাই ছিলেন এই পুতুলের সৃষ্টিকর্তা। আঙুলের আকারের এই পুতুলগুলি নরম মাটি দিয়ে তৈরী করা হয়। এই স্থানে সহজলভ্য মার্কারী-সালফাইড মাটি পুতুলের লাল রঙের জন্য ব্যবহার করা হত আর সেই রীতি অনুসারেই এই পুতুলগুলির নাম হিঙ্গুল। নরম মাটির সাহায্যে পুতুলগুলি নির্মাণ করার পর বেশ কিছু দিন রোদে শুকানো হয়, তারপর মনের মতো রং লাগানোর পর তৈরি হয়ে যায় হিঙ্গুল পুতুল।
পাশ্চাত্য ধাঁচের আভরণ এই পুতুল গুলিকে অনবদ্য করে তুলেছে। এই পুতুলগুলির পরিধান হিসেবে ফ্রক, ব্লাউজ এর সাথে টুপিকেও বেছে নেওয়া হয়। এই বার্বি ডলের যুগে হিঙ্গুল-এর পুতুল খেলা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। ফৌজদার পরিবারের এই ঐতিহ্যবাহী পুতুলটি মাত্র ৩০ টাকা জোড়ায় পেয়ে যাবেন।
পাঁচমুড়ার টেরাকোটা শিল্প -
আপনি যদি কখনও বিষ্ণুপুর ভ্রমণে যান তাহলে টেরাকোটা মন্দিরের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। তাই, ফেরার পথে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে মন্দিরের বাইরে থেকে টেরাকোটা শিল্পের কিছু জিনিস কিনে আপনার অন্দরমহল সাজিয়ে নিতে পারেন।
কিন্তু আপনি যদি এই শিল্পের স্রষ্টাদের সঙ্গে পরিচয় করতে চান, তাহলে বিষ্ণুপুর থেকে ২৫ কিমি দূরে পৌঁছে যেতে পারেন পাঁচমুড়া গ্রামে। এখানে আপনি গ্রাম বাংলার সাথে সাথে শিল্পীদের সঙ্গেও প্রত্যক্ষ আলাপচারিতা সেরে আসতে পারেন। এখানে প্রতিটি বাড়িতেই শিল্পীদের বাস; শুধু তাই নয় শিশুরাও টেরাকোটা শিল্পে বেশ পটু।
শঙ্খ বলতেই আমরা সমুদ্র থেকে নির্মিত শঙ্খকেই বুঝি; কিন্তু এখানকার শিল্পীরা প্রকৃত শঙ্খ-এর আদলে শঙ্খ নির্মাণ করেন। অবিশ্বাস্যভাবে ঠিক একই রকম ধ্বনির উৎপত্তি হয় এই টেরাকোটার শঙ্খ থেকেও। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এই শিল্পীরা তাঁদের শিল্পের যথার্থ মূল্য পান না।
বালুচরী ঘরের বালুচরী শাড়ি
বাংলার গৌরবের অপর একটি নিদর্শন হলো বালুচরী শাড়ি। এই শাড়ির সূচনা প্রায় ২০০ বছর আগের মুর্শিদাবাদের বালুচর স্থান থেকে।
বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-এর রাজত্ব কালে এই শাড়ি শিল্প আরও বিস্তৃতি পায়। সূচনাকালে শাড়ির মধ্যে রাজসভার ছবি অঙ্কিত থাকতো, পরবর্তী কালে নবাব কিংবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিত্রাঙ্কন করা হত ।
১৯ শতকের পরবর্তী সময়ে এবং বর্তমানে বালুচরী শাড়ি বিষ্ণুপুরে তৈরী করা হয়। মল্ল রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় বালুচরী শাড়িতে কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। এই শাড়িতে রামায়ণ এবং মহাভারতের মতো মহাকাব্যের অমরগাঁথা বর্ণিত হতে থাকে। একটা শাড়ি বানাতে সময় লেগে যায় প্রায় এক সপ্তাহ। বর্তমানে তিন ধরণের বালুচরী শাড়ি পাওয়া যায় - বালুচরী (motif) নির্মাণের জন্য কেবলমাত্র একটি রঙের সুতো ব্যবহৃত হয়), মীনাকারী বালুচরী motif নির্মাণের জন্য বিভিন্ন রঙের সুতো ব্যবহৃত করা), স্বর্ণচরী motif নির্মাণের জন্য কেবলমাত্র সোনালী রঙের সুতো ব্যবহার করা হয়। এই শাড়ীর মূল্য ৫০০০ টাকা থেকে শুরু। বালুচরী শাড়ি নির্মাণের প্রত্যক্ষদর্শী থাকতে পৌঁছে যেতে পারেন দলমাদল ক্যানন-এর কাছের মিলগুলিতে।
শুশুনিয়া পাহাড় -
আপনি যদি পাহাড়প্রেমী হন এবং ট্রেকিং শেখার ইচ্ছে থাকে, তাহলে বিষ্ণুপুর থেকে ৬০ কিমি দূরে শুশুনিয়া পাহাড় পৌঁছে যেতে পারেন। ট্রেকিং শেখার সাথে সাথে সুন্দরী প্রকৃতির সাক্ষাৎ পাবেন। ভাস্কর্য শিল্পীরা এই পাহাড় থেকে পাথর সংগ্রহ করে অসাধারণ শিল্প-ভাস্কর্য্যের সৃষ্টি করে থাকেন।
কম খরচে এই ট্রিপটা কিন্তু অনাবিল আনন্দ এনে দিতে পারে।